জলবায়ু পরিবর্তনভ্রমণ

দুবাইতে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার সাথে হঠাৎ দেখা

জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন কাভার করতে ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানের বিলাসবহুল বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে পৌঁছে প্রথমবার দুবাইয়ের মাটিতে পা রাখলাম। দুবাই এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে ইন্টারনেটসহ একটা সিম কার্ড দিয়ে ওয়েলকাম জানালেন আমিরাতের ইমিগ্রেশন অফিসার।

এসেছি জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন কভার করতে। এখানে বিশ্বের বড় বড় নেতাদের এক ছাদের তলায় এনে দাঁড় করিয়েছে এই সম্মেলন। সাংবাদিক হিসেবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সাক্ষী থাকতে পারাটা আমার কাছে বিরাট সুযোগ।

বন্ধুরা, আমি এম আর জান্নাত স্বপন। ঢাকার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ভালো সংবাদে কাজ করি। ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে দুবাই ভ্রমণ করি। চলুন আপনাদের নিয়ে আমার ১১ দিনের এই ভ্রমণ গল্প শুরু করি।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে,  বাইরের বিল্ডিংয়ের প্যাটার্ন ও খেজুর গাছ  দেখেই বুঝতে পারলাম, মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এসে পড়েছি। সিনেমায় যেমন দেখা যায়। তেমনই সব বিল্ডিং।

এই যে বড় বড় বিল্ডিংগুলো দেখছেন এ গুলো মূলত বাংলাদেশি প্রবাসীরাই বানিয়েছেন। দুবাই শহরের বেশিরভাগ তাক লাগানো ভবনের কারিগর বাংলাদেশিরা। দুবাইয়ের নির্মাণ খাতে ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি সরাসরি যুক্ত।

আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যের এক ছোট দেশ হলেও বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। এখানকার এক টাকায় বাংলাদেশে ৩৪ টাকা হয়। এই দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ বাংলাদেশি। যদিও তারা নাগরিক নন, অভিবাসী। এখানে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ বাংলাদেশি অন্তত ৪০টি পেশায় কাজ করেন। পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন, তার মধ্যে সংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত।

চলছি দুবাই শহরের পথে পথে। কি এক আজব শহরে এসে পড়লাম। এই শহরের মানুষ গুলো রাতেও ঘুমায় না। নানা দেশের অন্তত লাখো পর্যটক প্রতিদিন এই শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান। প্রতিবছর প্রায় ২ কোটি পর্যটক দুবাইয়ে আসেন। বিশ্বের সেরা পর্যটন গন্তব্যের মধ্যে এই দেশটি অন্যতম। আরব আমিরাতের প্রধান আয়ও এই পর্যটনখাত থেকে। রাতের দুবাই উপভোগ করতেই বেশিরভাগ পর্যটক আসেন এখানে। দুবাইয়ের চোখ ধাঁধানো উঁচু উঁচু ভবন দেখতেও সারা বিশ্বের মানুষ এখানে আসেন।

জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম কয়েক দিন ছিল বেশ ব্যস্ততা আর উত্তেজনায় ভরা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিক, পরিবেশবিদ, রাজনীতিবিদদের ভিড়ে দুবাই এক্সপো সিটি যেন এক অন্য দুনিয়া। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নানা আলোচনা, বিতর্ক, চুক্তি—সব মিলিয়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

সে সময়ের পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকারের সঙ্গে সেখানে দেখা হয়।

বর্তমানে এই ভিডিওটা যখন প্রকাশ হচ্ছে তখন আনোয়ার উল-হক কাকার একজন প্রাক্তন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ। যিনি ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৮ম তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০২৪ সালের  ৪ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন তার পূর্বসূরি শাহবাজ শরীফ। যিনি ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে পাকিস্তানের ২০তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বর্তমানে সে দেশে দায়িত্ব পালন করছেন।

যাইহোক, আনোয়ার উল-হক কাকারকে সামনাসামনি দেখার, ছবি তোলার এবং তাঁর ইভেন্ট কাভার করার সুযোগ পাই। তিনি সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে ছবিও তুলে দেই আমি। আনোয়ারুল হক কাকারের মতে, সমস্যা সমাধানের জন্য একজোট হয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। শক্তিশালী পদক্ষেপ না নিলে উন্নত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে নজর দেবে না বলেও জানান তিনি।

মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল্‌, ভুটান সহ বাংলাদেশের মন্ত্রী, আমলাদের সঙ্গে কয়েকটি সাইড মিটিংয়ে অংশ নিয়ে সেগুলোর নিউজ ভালো সংবাদের জন্য করার সুযোগ হয় আমার। দেশ-বিদেশের অনেকের সঙ্গে পরিচিত হই।

জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রতিবছর ৪০০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪ বিলিয়ন। উন্নত দেশগুলোর অর্থ দেওয়ার এই গড়িমসিতে ক্ষুব্ধ বিজ্ঞানী, গবেষক ও জলবায়ু কর্মীরা। জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এ চিত্র স্পষ্টই ফুটে উঠেছে।

জাতিসংঘ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত চরবাসীরা সরাসরি কথা বলেছেন। নদী ভাঙন, বন্যায় তাদের সর্বস্ব হারানোর গল্প শুনে বিশ্ব নেতারা অবাক হয়েছেন। যা এর আগে কখনো হয়নি। এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে আওয়াজ তোলা দলটি বেশ বড়। চরের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কিশোরীরাও এসেছেন।

জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন মোকাবিলা ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের নেওয়া অনেক পদক্ষেপ বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়েছে বলেও এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন তারা।

দুই’শ কোটিরও বেশি মানুষের দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। ২০৫০ সালের মধ্যে যেখানে অন্তত দুই কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আটাশতম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে সে কথা উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরছেন বিশেষজ্ঞরা।

জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর অন্তত ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুবাই শহরটাকে একটু কাছ থেকে দেখার সুযোগও পেয়েছি। এই সফরে দুবাইয়ের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান আর জমজমাট মার্কেট ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। জাতিসংঘের কপ ২৮ জলবায়ু সম্মেলনে প্রথম দিনেই আইডি কার্ড সংগ্রহ করার পর মেট্রো পাসকার্ড আর সুন্দর একটা পানির বোতল উপহার পেয়েছি। দুবাইয়ের বাস আর মেট্রোতে চলাচল করতে সাংবাদিকদের জন্য কোনো ভাড়া লাগেনি। পুরনো শহর দেইরা থেকে প্রতিদিন সকালে মেট্রো রেলে করে দুবাই এক্সপো সিটিতে যেতাম। ফিরতাম সন্ধ্যায়।

তারপর, হোটেলে এসে রেস্ট নিয়ে রাতের দুবাই দেখতে বের হতাম। বেশ কয়েকটি মলের ভিতর সিনেমা দেখার সুজুগ হয়েছে আমার। টুকটাক শপিং, খাওয়া দাওয়ায় অভিজ্ঞতাও ছিল দারুণ। আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম আর আরামদায়ক সিটে বসে সিনেমা দেখার অনুভূতি ছিল একেবারেই অন্যরকম। দেইরা এলাকায় ৩ স্টার মানের হোটেলে ছিলাম। হোটেলটি বেশ ভালো ছিল এবং এখানকার কর্মীরাও খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।

সব মিলিয়ে দুবাইয়ের এই ভ্রমন আমার জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। একদিকে কপ ২৮ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অংশ নেওয়া, অন্যদিকে দুবাইয়ের চোখ ধাঁধানো রূপ আর জমজমাট মার্কেটগুলোর অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ।

রাতে ভাত খাওয়া ছাড়া আমার ঘুম ধরে না। সেই আমি, আমার দুবাই ভ্রমণের প্রথম ৮ দিন ভাত খাইনি। আফগানি নান এবং এরাবিক খাবার খেয়েছি। কারণ ছিলো দুবাইয়ের ফুড কালচার খুব কাছে থেকে দেখা।

দুবাইতে রয়েছে মূল্যবান পণ্য কেনাকাটার সুযোগ। তবে আপনি যদি মূল্যবান ব্র্যান্ডের জিনিস কিনতে পছন্দ করেন তাহলে দুবাই হতে পারে আপনার অন্যতম পছন্দের জায়গা।

দুবাইয়ের পার্কিং এবং ট্র্যাফিক ব্যবস্থা অনেক কঠোর। এখানে গাড়ি পার্কিং’র জায়গা সহজে পাওয়া যায়না। নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং না করলে জরিমানা, এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। হতে পারে আপনার গাড়ির ও জেল। গাড়ির জেল হয় এমন কথা শুনেছেন কখনো? শুনে থাকলে কমেন্ট করে জানান।  

বন্ধুরা, এই সফরে দুবাই শহরে যে দর্শনীয় যায়গাগুলো আমি আসা জাবার মাঝে প্রতিদিন ২ বার করে দেখেছি সে গুলো আপনাদের জানাতে চাই। বুর্জ খলিফা, বিশ্বের উচ্চতম ভবন। দুবাই মল, কেনাকাটার স্বর্গরাজ্য। দুবাই ফ্রেম, ১৫০ মিটার উঁচু ফ্রেম আকৃতির কাঠামো। মিউজিয়াম অফ দি ফিউচার, ভবিষ্যতের উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি প্রদর্শনের জন্য নির্মিত অনন্য স্থাপত্য। আটলান্টিস পাম হোটেল, পাম জুমেইরা দ্বীপে অবস্থিত বিলাসবহুল হোটেল। বুর্জ আল আরব, বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল হোটেল। পাম জুমেইরা বিচ, পাম গাছের মতো দেখতে কৃত্রিম দ্বীপ। আইন দুবাই, বিশ্বের বৃহত্তম পর্যবেক্ষণ চাকা। দুবাই ফাউন্টেইন, বুর্জ খলিফার পাদদেশে অবস্থিত রঙিন জলের নাচের ফোয়ারা। দেইরা এলাকা, দুবাইয়ের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী এলাকা। যেখানে স্বর্ণের বাজার ও মসলার বাজার রয়েছে। এসব দর্শনীয় জায়গায় দেখার আমার ভ্রমণ সঙ্গী ছিলেন সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি আশিস গুপ্ত। তিনি ইন্ডিয়ান নাগরিক।

দুবাইয়ের এই ভ্রমণ আমার জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। একদিকে কপ ২৮-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অংশ নেওয়া। অন্যদিকে দুবাইয়ের চোখধাঁধানো রূপ আর দেইরার জমজমাট মার্কেটগুলোর অভিজ্ঞতা – সব মিলিয়ে এই সফর ছিল অসাধারণ।

দুবাই ভ্রমন শেষে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়। এই ভ্রমণ আমাকে শিখিয়েছে কি ভাবে মানুষের সাথে চলতে হয়। মোট কথা ম্যানার শিখেছি। দেশে ফেরার সময় আবারো বাংলাদেশ বিমানের বিলাসবহুল বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে ছিনামা দেখতে দেখতে ঢাকায় ফিরি। শীঘ্রই দেখা হবে কথা হবে আপনাদের সাথে। সে পর্যন্ত ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button