বিদেশমতামত

করোনা পরবর্তী বিশ্ব নেতৃত্বে চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র

Exclusive News Usa Chinaকখন, কোথায় যেয়ে থামবে এ মৃত্যুর মিছিল কেউ জানে না। কেউ জানে না করোনাভাইরাসের তান্ডব কবে থামবে, কবে ফিরে আসবে স্বাভাবিক জীবন। তারপরও এ ভাইরাসের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব রাজনীতি আর বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ দখলের চেষ্টা।

রাজনীতিক, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন মহল করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে নানা আভাস-ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তাদের মতে, এ ভাইরাস বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন যে আনছে এটা নিশ্চিত। কিন্তু পরিবর্তীত সে বিশ্বব্যবস্থায় চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র- কে নেতা হবে তা নিয়েই চলছে তুমুল আলোচনা।

তবে যে দেশগুলো করোনাভাইরাস মহামারি সবচেয়ে ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারবে, অন্যদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে তারাই যে দৌড়ে এগিয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই।

ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি শুধুমাত্র জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরীক্ষাই নেবে না বরং তা আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোরও মূল্যায়ন করবে।

এ পরিস্থিতিতেও উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে দেনা-পাওনা নিয়ে লড়াই আরও জোরদার হয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়েছে মহামারি মোকাবেলায় ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রস্তুতি ও ক্ষমতার অভাব। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জোসেফি কন্টে কোন রাখঢাক না করেই বলেছেন, ব্যর্থ হলে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ভেঙ্গে যেতে পারে।

আর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যাডাম টুজ তার ‘আমেরিকা দুর্বলতাপীড়িত, কিন্তু তারপরও বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে’ লেখার শিরোনামেই তার যা বলার বলে দিয়েছেন।

সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল বিল্ড’র টুইট বার্তাকে উল্লেখ করে তিনি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখেছেন, এটি আমেরিকা-পরবর্তী বিশ্বের প্রথম মহাসঙ্কট। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, জি-২০ সৌদি আরবের যুবরাজের হাতের মুঠোয়। আর হোয়াইট হাউজ বছরের পর বছর ‘আমেরিকা আগে’ নীতির ডুগডুগি বাজিয়ে যাচ্ছে বলে অনেক বছর ধরেই সবাই একা। শুধুমাত্র এ মহামারিই বৈশ্বিক রূপ পেয়েছে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন এম. ওয়াল্ট এখনও যুক্তরাষ্ট্রের উপর বাজি ধরে রেখেছেন। তার আশা, ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক ভুল করলেও পররাষ্ট্র বিষয়ক কিছু নীতি বদলে যুক্তরাষ্ট্র এখনও করোনাভাইরাস মহামারির যুদ্ধে জিততে পারে, আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ফিরতে পারে বিশ্বমঞ্চে।

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে তার লেখা অনুযায়ী, এ আন্তর্জাতিক সমস্যার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি ‘আমেরিকা আগে’  নীতি বজায় রাখে, যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা নাইন-ইলেভেন অথবা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময়কার মত নেতৃত্ব দেখাতে না পারে তবে আশা করার আর কিছু থাকবে না।

তবে অধ্যাপক ওয়াল্ট স্বীকার করেন, করোনাভাইরাস পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ক্ষমতা ও প্রভাবের পরিবর্তনের ধারাকে আরও জোরদার করবে। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর সেরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং চীন তার প্রাথমিক ভুল সংশোধন করে ভালভাবেই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে।

তিনি আরও স্বীকার করেন, এ ব্যাপারে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সন্দেহজনক এবং সম্ভবত তা পশ্চিমা খ্যাতির শক্তিকে দুর্বল করে তুলেছে।

নিজের ঘরের মড়ার মিছিল পিছনে রেখে করোনাভাইরাসের মত আন্তর্জাতিক মানবিক সঙ্কটে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে চীন। তার সে দরদী হাত পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ইউরোপ, আফ্রিকার নানা প্রান্তে।

প্রতিযোগিতামূলক এ যুদ্ধে পশ্চিমাদের তুলনায় ‘পূর্ব’ যে এগিয়ে রয়েছে অনেকে এরইমধ্যে সে দাবি করেছেন। কোন দ্বিধা ছাড়াই দক্ষিণ কোরিয়ার দার্শনিক বাইয়ুং-চুল হান দাবি করেছেন, জাপান, কোরিয়া, চীন, হংকং, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের মত এশীয় অঞ্চলকে জয়ী বলা যেতে পারে।

কোরীয় এ দার্শনিকের মতে, চীন এখন মহামারির বিরুদ্ধে সাফল্যের জন্য তার ‘ডিজিটাল পুলিশ’ ধারণা বিক্রি করতে সক্ষম হবে। চীন তার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব আরও গর্বের সঙ্গে তুলে ধরবে। এ কারণে হয়তো পশ্চিমা ভোটাররা তাদের অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে রাজি হবে।

ভূ-রাজনীতির নীরব খেলোয়াড় চীন গত ২০ বছর ধরে প্রতিটি বৈশ্বিক সঙ্কটকে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ এবং বারাক ওবামা দু’জনেই চীনকে আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগী হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই চীন পরিস্থিতি পাল্টে দিতে সক্ষম হয়।

 

প্রথমত, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর সন্ত্রাস-বিরোধী কর্মসূচিতে সহযোগীতা এবং দ্বিতীয়ত, ২০০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় বিশ্বজুড়ে চাহিদাকে উৎসাহিত ও আর্থিক বাজারকে শান্ত করতে সহায়তা করে চীন তার বন্ধুত্বের উদাহরণ তুলে ধরে।

একইভাবে ইউরোজোন ঋণ সংকটের সময় গ্রিক, পর্তুগিজ এবং স্প্যানিশ বন্ড কিনে ইউরোপের সাথে তার সম্পর্ককে আরও জোরদার করে চীন। এর পাশাপাশি চীন ইউরোপ থেকে আমদানি ও বিনিয়োগ বাড়ায়।

পর্তুগাল, আর্জেন্টিনা এবং মিসরের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও পিপলস ব্যাংক অব চায়না উদ্ধার প্যাকেজ সরবরাহ করে ও ঋণ ঝুঁকি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়।

হাসপাতালগুলির জন্য প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, ফেস মাস্ক এবং প্রতিরক্ষামূলক যন্ত্রপাতি উত্পাদনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত। চীনকে তাই এগুলো সরবরাহ ও করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া উচিত। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রকে চিকিত্সা সামগ্রী সরবরাহের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত বলে চীনের অনেক নাগরিক পরামর্শ দিয়েছেন।

এখন চীন করোনাভাইরাস সঙ্কটের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে যেয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি তার প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানকে আরও খোলামেলা ও অগ্রণী ভূমিকায় পরিণত করতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে চীনা নেতারা তাদের সামনে থাকা করণীয় এবং সুযোগ দুটোই বুঝতে পেরেছেন।

# লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

atmustakim@gmail.com

এমন আরো সংবাদ

Back to top button