ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি মানবজাতি। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের হিসাব অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে শুধুমাত্র এশিয়ায় ৯ লাখ ও আফ্রিকায় ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। তবে বৈশ্বিক এ সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না।
এ সংকট মোকাবেলায় প্রথমেই প্রয়োজন জরুরীভিত্তিতে একটি সহজ ওষুধ আবিষ্কার করা। যাতে করে এ ভাইরাসের সংক্রমন রোধ করে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো যায়।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বৈশ্বিক নেতৃত্ব খুঁজে বের করা। যে নেতৃত্ব ঐ ওষুধ তৈরিতে সমর্থন ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা যোগাবে। পরিসংখ্যান বলছে, ধনী দেশগুলোতে প্রতি সাতজন জটিল রোগীর জন্য হাসপাতালে মাত্র একটি করে শয্যা রয়েছে। সেখানে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অবস্থা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।
এসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দুর্বল ও সামাজিক নিরাপত্তা অপর্যাপ্ত। তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসাকর্মী ও জাতীয় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তত ৩৫ বিলিয়ন ডলার অর্থের দরকার।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মত দুর্বল স্বাস্থ্যসেবার দেশগুলিতে এ মহামারীর বিস্তার রোধে যদি কিছু না করা হয় তবে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাদের মাধ্যমে বিশ্বে আরেকদফা এ মহামারী ছড়িয়ে পড়বে।
তৃতীয়ত, করোনাভাইরাস বিধ্বস্ত বিশ্বে অর্থনীতির পতন ঠেকাতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারগুলো অর্থনীতির পতন ঠেকাবার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও বাস্তব পরিস্থিতিতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। তাই আজকের মন্দা যাতে আগামী দিনের সংকট না হয়ে দাঁড়ায় সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে অর্থনীতি, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং বানিজ্যিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এবারের অর্থনৈতিক সংকট শেষ হবে না। আর শুধুমাত্র বিশেষ কোন দেশের অসুখ বিবেচনায় নিলে এ স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা কাটবে না। এ জরুরি অবস্থা শুধুমাত্র তখন শেষ হতে পারে যখন সব দেশ করোনাভাইরাস মুক্ত হবে এবং এর ফিরে আসার আশঙ্কা আর থাকবে না।
সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বিশেষ ধরণের অর্থনৈতিক সহায়তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের টাকা মওকুফ করতে হবে। বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে ১৫০ বিলিয়ন ডলার যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সম্পদ ও জনশক্তি জড়ো করার আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক মনোভাব দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। এ সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন কার্যকরী নেতৃত্ব।
গত ২৬ মার্চ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি-২০’র নেতারা ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। বৈশ্বিক জিডিপির ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাধর এসব দেশের এ সংগঠন। বিশ্বসংকট মোকাবেলা এবং তার সমাধান করার জন্য মূলতঃ গড়ে উঠেছিল জি-২০।
তবে দুঃখজনকভাবে কোন বাস্তব প্রতিশ্রুতি ছাড়াই সে ভিডিও কনফারেন্স শেষ হয়। নেতারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নিজ নিজ উদ্যোগে মহামারী নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন এবং বিষয়টির আলোচনা অর্থ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের উপর ছেড়ে দেন।
কিন্তু ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের সময় জরুরি ভিত্তিতে ওয়াশিংটনে জড়ো হয়েছিলেন জি-২০ নেতারা। সেখানে তারা অর্থনৈতিক নীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন।
এর আগে সুনামি, গৃহযুদ্ধ বা মহামারীর মত জরুরি অবস্থায় বিভিন্ন দেশের জোট প্রয়োজনীয় তহবিলের জন্য দাতাদের সম্মেলন আহ্বান করেছে। আজকের এ বৈশ্বিক জরুরি অবস্থায় জি-২০’র পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সমর্থনের সমন্বয় করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন এবং সে সমর্থন বাস্তবায়নে দাতা সম্মেলন, দু’টিই করতে হবে।
চলমান মহামারীতে এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এক লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারালেও বিশেষত্ব ও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটি আলাদা। অর্থনৈতিক সংকট বা ইবোলা ভাইরাসের বিস্তারের চেয়ে এ মহামারী ভিন্ন ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার পশ্চিমা দেশগুলির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে নাজুক আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে জবুথবু করে বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে, এঙ্গেলা মারকেল, বরিস জনসন, ইমানুয়েল ম্যাখোঁ থেকে ভ্লাদিমির পুতিন পর্যন্ত বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির নেতাদের নিজদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় অসহায় মনে না হলেও তারা যে চাপে আছেন তা স্পষ্ট।
এ ভাইরাস যখন আশঙ্কাজনক গতিতে ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও যুক্তরাজ্যে মানুষ হত্যা করে চলেছে তখন তাদের নেতারা সীমান্তের বাইরে নজর দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।
যখন বিভিন্ন দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ ও অঞ্চলগুলো লকডাউন করে বহুপক্ষীয়তার মৃত্যু সংবাদ লেখার চিন্তা করছে তখন এক অন্য ধরণের বৈশ্বিক সহযোগিতা তার জায়গা করে নিচ্ছে।
যেমন, বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম কমাতে নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করছেন এবং মহামারী সংক্রান্ত তথ্য, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা পদ্ধতি আদান-প্রদান করছেন।
একটি ওষুধ খুঁজে বের করতে ফেসবুক, ইমেইল ও ওয়েব পেজের মাধ্যমে পক্ষগুলোর মধ্যে সহযোগিতামূলক কাজ এগিয়ে চলেছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন কমিটি আগামী ১৭ থেকে ১৯ এপ্রিল যে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে সেখানে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার অপেক্ষা করছে বিশ্ববাসী। সংকট এড়ানোর এটাই সম্ভাব্য সবচেয়ে ভাল পথ। আর এ পথকে যদি ব্যয়বহুল মনে করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় তবে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
বিশ্ব নেতারা যদি এবারের এ পরীক্ষায় ব্যর্থ হন তবে তাদের অনেক কিছুই হারাতে হবে।
# লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট