বিশে^র উন্নত অর্থনীতির দেশগুলিকে বিধ্বস্ত করে এগিয়ে চলেছে করোনাভাইরাস। মৃত্যু আর মানুষের ভোগান্তির মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। তার সাথে যোগ হচ্ছে বিশাল খেলাপির সাথে বিপর্যয়কর মন্দা। আর্থিক বাজারে বাড়ছে করপোরেট ঋণের ঝুঁকি।
ধনী দেশগুলোর জন্য পরিস্থিতি সহনীয় হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভিন্ন অবস্থা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তা শুধুমাত্র রোগের বোঝা বহনের দিক দিয়েই না, আসন্ন বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনার দিক দিয়েও।
স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করেছেন। তবে তা শুধুমাত্র ধনী দেশগুলোকে কেন্দ্র করে। স্বাস্থ্য বিশারদরা মূলত জোর দিচ্ছেন সংক্রমন রোধের উপর। আর তা রোধে সামাজিক দূরত্ব এবং লক ডাউন নিয়ে কথা বলছেন তারা। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এ বৈশি^ক মহামারীকে দেখছেন চাহিদার নেতিবাচক ধাক্কা হিসাবে। এর মোকাবেলায় ব্যয় বাড়াতে অর্থনীতির আওতা বড় করতে বলছেন তারা। শিগগিরই তাদের অনেকে বুঝতে পারেন যে, এ ধাক্কাটা ভিন্ন ধরণের। এটা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের মত না। সে সময় চাহিদার পতন ঘটেছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের মত বৈশি^ক মহামারী সরবরাহের ক্ষেত্রে আঘাত হিসেবে এসেছে। এটাই সবকিছুকে বদলে দিচ্ছে।
মানুষ যদি না চায় বা ব্যয় করতে না পারে, সেক্ষেত্রে ব্যয়ের ক্ষমতা বাড়ালে তা কার্যকর হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়, স্কুল, হোটেল বা এয়ারলাইন যদি করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বন্ধ রাখা হয়, সেক্ষেত্রে জনগণের হাতে অর্থ দিলেও তা এসব শিল্পখাতকে চাঙ্গা করতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে চাহিদার অভাব নেই। সংক্রমন রোধে জনস্বাস্থ্য নীতি বাস্তবায়ন করতে যেয়ে এগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা লক ডাউনে থাকার কারণে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি উৎপাদন করতে না পারে, সেক্ষেত্রে চাহিদা বাড়লেও নাটকীয়ভাবে পণ্য এসে হাজির হবে না।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা সরবরাহের ক্ষেত্রে যে ধাক্কা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সামাজিক দূরত্ব ও লক ডাউনকে সহনীয় করে তোলার দিকে নজর দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকার বড় ধরণের ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে যাতে করে স্বাস্থ্যসেবা আরও বাড়ানো যায়, বেতনাদি নিয়মিত দেয়া যায়, যাতে করে আরও বেশি বেকারদের বীমার আওতায় আনা যায়, দেরিতে কর পরিশোধ করা যায়, অনাকাঙ্খিত দেউলিয়াত্ব রোধ করা যায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিবারগুলো যাতে এ ঝড় থেকে রক্ষা পায়।
তবে এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে সাধারণ ধারণা হল সরকারগুলো প্রয়োজনীয় সম্পদ যোগাড়ে সক্ষম হবে। প্রয়োজন হলে নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বেশি করে ধার নিতে হলেও তারা নেবে। সরকারের এই ধার নেয়ার সামর্থকে অর্থনীতিবিদরা অর্থনৈতিক আওতা বলে বর্ণনা করছেন। সংক্ষেপে বলা যায়, সংক্রমনের মাত্রাকে আপনি যত কমাতে চাইবেন, আপনাকে আপনার দেশ তত বেশি লক ডাউন করতে হবে। আর এতে করে যে গভীর মন্দা সৃষ্টি হচ্ছে তা ঠেকাতে অর্থনীতির আওতা আরও বাড়াতে হবে।
এ বিষয়গুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে হঠাৎই ঝুঁকিতে ফেলেছে। এমনকি ভাল সময়েও এসব দেশের অনেকটিই সতর্কতার সাথে অর্থনীতি পরিচালনা করে থাকে। আর ছাপাখানার উপর নির্ভর করে মুদ্রা চালায় এবং মুদ্রাস্ফীতির যন্ত্রণা ভোগ করে। কিন্তু এটা করার সময় এখন না।
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশ পণ্য রফতানি, পর্যটন এবং রেমিট্যান্সের মিশ্রনে বিদেশি আয়ের উপর নির্ভর করে। এ সকল খাতে ধস নামায় এ সরকারগুলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা শূণ্যতা ও কর রাজস্বের অভাবে ভুগতে থাকে। এ সময়ে আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশ করাটা তাদের জন্য কঠিন। কারণ, বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ধনী দেশগুলোর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন বৈশি^ক এ মহামারী রোধ করতে যাচ্ছে তখন তাদের আর্থিক ক্ষমতার বিশাল অংশ উধাও হয়ে যাচ্ছে এবং বিশাল তহবিল ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজস্ব ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংকট মোকাবেলায় দু’টি সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত: মিতব্যয়িতার মাধ্যমে কঠোরভাবে আয় অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত: অবমূল্যায়নের মাধ্যমে দুষ্প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রাকে দামি করে তুলতে হবে। আর আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে এর সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু এর ফলে দেশগুলো করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্পদহীন হয়ে পড়বে এবং লক ডাউনের প্রভাবে অর্থনীতির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। সর্বোপরি, আর্থিক সংকট মোকাবেলায় সব দেশ এক সাথে সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে তা অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং তা প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলো করোনা ভাইরাসের সংক্রমন রোধ করতে চাইলেও সক্ষমতার অভাবে তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে জনগণ যদি ঘরে আটকে থাকলে অনাহার আর কাজে গেলে মৃত্যুর ১০ শতাংশ ঝুঁকির মধ্যে থাকে তবে তারা কাজ করতে যাওয়াটাই পছন্দ করবে।
দেশগুলোকে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আর্থিক সক্ষমতা দিতে একটি স্তর পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বর্তমান আর্থিক অবস্থায় সে সহায়তা দেয়া সম্ভব না। বিশে^র দক্ষিণাঞ্চলে এ মহামারী ব্যবস্থাপনায় অর্থের পুনঃআবর্তন খুবই জরুরি। সেক্ষেত্রে শিল্পোন্নত জি-সেভেন এবং জি-টুয়েন্টি বেশ কিছু পদক্ষেপ বিবেচনা করতে পারে।
প্রথমত, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ডেনমার্ক, কোরিয়া, মেক্সিকো, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং সুইডেনের ব্যাংকগুলোর সাথে সোয়াপ লাইনের কথা ঘোষণা করেছে। সোয়াপ লাইন হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে অস্থায়ী পারস্পরিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে তারা চলমান বিনিময় হারে অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যবসার জন্য তাদের দেশের মুদ্রা সরবরাহ করতে রাজি হয়। ব্যাংকগুলি এটি দ্রুত এবং স্বল্পমেয়াদী ঋণের জন্য ব্যবহার করে থাকে। এ ব্যবস্থার আওতা বাড়িয়ে আরও অনেক দেশকে এর অধীনে আনতে হবে। যদি ডিফল্ট বা অর্থ পরিশোধের অক্ষমতার আশঙ্কা এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এ তহবিলের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ মধ্যস্থতা করতে পারে। বর্তমান চাহিদা মেটাতে আইএমএফ বিদ্যমান দ্রুত অর্থায়ন ব্যবস্থাকে প্রয়োজনে নতুন করে ঢেলে সাজাবে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কোয়ানটিটেটিভ ইজিং (কিউই) বা পরিমাণগত স্বাচ্ছন্দ্য বাস্তবায়ন করবে। কোয়ানটিটেটিভ ইজিং মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিতে সরাসরি অর্থ যোগাতে পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণ সরকারী বন্ড বা অন্যান্য আর্থিক সম্পদ কিনে থাকে। কিউই বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্ভাবনাময় কিন্তু কম ঝুঁকিপূর্ণ বন্ডগুলো কিনতে পারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য জটিল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারবে।
তৃতীয়ত, ডলারভিত্তিক বা ইউরোভিত্তিক অর্থনীতি বা যাদের নিজস্ব মুদ্রা নেই তাদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা ঘোষণা করতে হবে। এতে করে ঐ দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহায়তা করতে পারবে।
শেষত, উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন মেডিক্যাল ডিভাইস এবং ওষুধপত্র রফতানী বন্ধ করা উচিত হবে না।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত অর্থনৈতিক কর্মসূচী প্রয়োজন। এ কর্মসূচীতে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। সমস্যাটিকে একটি বৈশি^ক রূপ দিতে হবে। সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে, সঠিক কাজটি করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ।