
বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ আজ দূষিত। খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, স্বাস্থ্যের অবনতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে, যা পৃথিবীকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে ‘আর্থ সামিট’ অনুষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল পরিবেশ ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ তৈরি করা। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয়গুলিকে একত্রিত করে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে সাময়িক উন্নয়ন সম্ভব হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী নয়।
শিল্পায়ন ও পরিবেশ

দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পৃথিবী আজ বিপন্ন। তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে মানুষ পরিবেশের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। তা সত্ত্বেও, অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার বাড়াতে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করা হচ্ছে। শিল্পায়ন যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়ন ও তাকে ঘিরে নগরায়ন পরিবেশের সংকট সৃষ্টি করেছে। শিল্প বিপ্লবের সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রধান পথ হিসেবে নগরায়ন এবং শিল্পায়নকে বেছে নেওয়া হয়। সেই যাত্রাপথে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে, সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণও বৃদ্ধি পেয়েছে। “Environmental Pollution in Asian Economies: Does the Industrialisation Matter?” নামের একটি গবেষণাপত্র দেখিয়েছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পায়ন এবং তা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের মধ্যে কী সম্পর্ক। ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪৬টি দেশকে ৫টি ভাগে ভাগ করে তাদের তথ্য নিয়ে গবেষণাপত্রটি তৈরি হয়েছে। গবেষণাপত্রটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, শিল্পায়ন দীর্ঘমেয়াদে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদিও সেই প্রভাব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন।
দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলি ১৯৭০ সালের পর থেকে জোরকদমে নগরায়ন এবং শিল্পায়ন ঘটিয়েছে। ফলে, জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি কার্বন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমনও দ্রুত বেড়েছে। ১৯৯৭ সালে, আন্তর্জাতিক কিয়োটো প্রোটোকল চুক্তিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী পরিবেশের উন্নতির জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলিকে কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা কমাতে হবে। ঠিক হয়, উন্নত দেশগুলিকে তাদের গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণকে ১৯৯০ সালে যা ছিল তার চেয়ে অন্তত ৫% কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এই বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণের অঞ্চলভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়। ইউরোপীয় দেশগুলিকে তাদের গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৮% কমানোর সুপারিশ করা হয়। কানাডা এবং জাপানের জন্য তা ৬% বলা হয়। প্রথমে কিয়োটো প্রোটোকলের সময় নির্ধারণ হয় ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত, পরে দোহাতে নতুন সংশোধনী অনুযায়ী তা সম্প্রসারিত হয় ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। তবে ইউরোপীয় দেশগুলি প্রতিশ্রুতি দেয় তারা গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৫% কমিয়ে ফেলবে। যদিও এটি পরিবেশ বাঁচানোর অতি কার্যকরী উপায়, তবুও অনেকেই এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। শুরুতেই তো আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশ্বের সর্বাধিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলি এই কিয়োটো প্রোটোকল বানচাল করতে চেয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল ভারতের মতো দেশগুলিকে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের প্রশ্নে অনেক বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে উক্ত দেশগুলি নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। যাই হোক, নানা টানাপোড়েনের পর ১৯৯৭ থেকে পিছতে পিছতে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গিয়ে কিয়োটো প্রোটোকল চালু হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) দেখিয়েছে, উন্নয়নের কারণে ১৯৭০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মারণ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ২১ গিগাটন থেকে বেড়ে ৩৮ গিগাটন হয়েছিল। আনুপাতিক হিসেবে এই বৃদ্ধি প্রায় ৮০%। এ থেকে পরিষ্কার, মানুষ অ-পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়িয়েছে, যা বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটিয়েছে। এটাই জলবায়ু বিপর্যয়ের মূল কারণ। উন্নত দেশগুলি ক্রমাগত অতি মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য মারণ গ্যাসের নির্গমন ঘটিয়েছে। বর্তমানেও মাথাপিছু গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের হার ভয়াবহ। এর থেকে স্পষ্ট, উন্নয়নশীল দেশগুলিও ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাথে সাথে আরও বেশি মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ ঘটাবে।
তবে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ চিচিলনিস্কি মানবজাতির টিকে থাকার জন্য বায়ুমণ্ডলে জমা হওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডকে অপসারণের পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, কার্বন যেন বায়ুমণ্ডলের বাইরে থাকে, এটা নিশ্চিত করতে হবে। এর খরচ মেটাতে চিচিলনিস্কি একটি বাজারের কথা বলেছেন। সেখানে কার্বনকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বিক্রি করা হবে। আরেকটি সম্ভাব্য সমাধান হল ‘কার্বন ফার্মিং’। জীববিজ্ঞানী অ্যালান স্যাভরি সম্প্রতি পাটাগোনিয়ায় এই কৃষি চালু করেছেন। যদি এটাকে লাভজনক করা যায়, তাহলে বেসরকারি খাতে কার্বনকে ভালো কাজে ব্যবহার করা যাবে। তবে সফলতা নির্ভর করবে ক্রমবর্ধমান জোগান এবং দাম পড়ে যাওয়ার সময়ও ‘কার্বন ফার্মিং’ লাভজনক থাকছে কি না, তার ওপর। কার্বন ফার্মিং হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বাতাসের কার্বনকে মাটিতে সঞ্চয় করে তাকে চাষের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই কার্বনের উৎস বাতাসের গ্রিন হাউস গ্যাস। ফলে এই চাষ বাড়াতে পারলে বাতাসের গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রাকে অনেকটাই কমিয়ে ফেলা যাবে।
এই বিষয়ে প্রায় এক দশক আগে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কার্বন বাজার কতটা কার্বন নিঃসরণ কমাবে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কতটা কাজে আসবে, তা নিশ্চিত করতে এতদিন শুধু আলোচনা চলছিল। । ২০২৪ সালে কপ ২৯-এ বিশ্বব্যাপী কার্বন বাজার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি গৃহীত হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একটি বৈশ্বিক কার্বন বাজার তৈরি ও এর নিয়মনীতি নিয়ে দেশগুলি ঐক্যমত্যে এসেছে। ওই বাজারে তারা ‘কার্বন ক্রেডিট’ কেনাবেচা করতে পারবে। চুক্তি অনুযায়ী, বৃক্ষরোপণ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো নানা প্রকল্প হাতে নেবে দরিদ্র দেশগুলো। এভাবে প্রতি এক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর বিনিময়ে একটি ‘কার্বন ক্রেডিট’ পাবে তারা। বৈশ্বিক কার্বন বাজার থেকে অর্থের বিনিময়ে ওই ‘ক্রেডিট’ কিনতে পারবে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ‘ক্রেডিট’ কিনলে তারা এক টন কার্বন নিঃসরণের অনুমতি পাবে। চুক্তিটির সমর্থকরা বলছেন, এই চুক্তির ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়তে নতুন নতুন প্রকল্পে শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ হবে। নিয়মনীতি চূড়ান্ত হবার পর আগামী বছরেই রাষ্ট্রসংঘের সহায়তায় এই সংক্রান্ত বাণিজ্য শুরু হতে পারে।
পুঁজিবাদ ও পরিবেশ
কার্বন বাজার সংক্রান্ত চুক্তিতে যেটুকু বোঝা গেল, এই বাজারের লাগাম থাকবে পুঁজিবাদী দেশগুলির হাতে l কিন্তু পুঁজিবাদের মূল চালিকা শক্তি হলো ‘ভোগ’। তাই উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি একদিকে বিশ্বব্যাপী এই চরম ভোগের দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে, অন্যদিকে কিয়োটো থেকে কোপেনহেগেন, কানকুন থেকে ডারবান সর্বত্র পরিবেশ বাঁচানোর জন্য গৃহীত উদ্যোগগুলিকে ভেস্তে দেওয়ার নানা পরিকল্পনা করছে।
ষাটের দশকে প্রতিবাদী পরিবেশবিদ রাচেল কারসন বলেছিলেন, আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভোগের লোভকে সামনে রেখে সহজে দ্রুত মুনাফা অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য। আর এ থেকেই প্রকৃতি ও পরিবেশের যাবতীয় ক্ষয়ের সৃষ্টি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিবেশ দূষণ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা ও দূষণের বীজ, এই সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
মুনাফার পাহাড় গড়তে প্রাকৃতিক সম্পদের দেদার লুঠকে আড়াল করতেই পুঁজিবাদ সামনে নিয়ে এসেছে ‘সুস্থায়ী উন্নয়ন’ অথবা ‘সবুজ উন্নয়নের’ মতো মনমোহিনী স্তোক বাক্য। পুঁজিবাদের একমাত্র লক্ষ্য যেহেতু মুনাফা, তা সফল করতে ভারতের মতো প্রাকৃতিক সম্পদশালী দেশগুলিতে দেদার লুঠ চালাচ্ছে l প্রকৃতি ও মানুষের যথার্থ সংযোগ গড়ে তুলতে হলে প্রাকৃতিক সম্পদের এমন ঢালাও লুঠের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বৃহত্তর পরিবেশ আন্দোলন। পরিবেশ বাঁচাতে শিক্ষা নিতে হবে গোটা বিশ্বের নানা ঘটনা থেকে। উন্নত দেশগুলির প্রবল চাপ উপেক্ষা করে একাধিক উন্নয়নশীল দেশ তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা সুনিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়েছে। বলিভিয়া বছর কয়েক আগে এই পদক্ষেপের নেওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৩% থেকে ৬% এ পৌঁছে দিতে পেরেছে। রাশিয়া তাদের ইয়োকোস অয়েল কোম্পানিটির জাতীয়করণ করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে চীন তো বটেই, এমনকি নাইজেরিয়া বা কাজাখস্তানের মতো ছোটো ছোটো দেশগুলিও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অথচ ভারত সরকার, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে বেচে দিতেই যেন বেশি তৎপর। পুঁজিবাদী স্বার্থে সরকারি তৎপরতা – এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে না পারলে প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনের ভাবনাটি অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য।
লেখক: ড.দেবাশীষ মিথিয়া