
“কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও, সংবাদ কাভারেজ অব্যাহত রয়েছে।” ইজরায়েলি বোমা হামলায় নিহত সাংবাদিক জাবের আবু হাদরুস (৩৬) এর শেষ ভিডিও বার্তা। কুদস আল-ইয়াউম টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক জাবের আবু হাদরুস ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩-এ গাজার উত্তরাঞ্চলের নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে তার বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। তার সঙ্গে পরিবারের সাত সদস্যও মারা যান।
জেনেভা কনভেনশনের অ্যাডিশনাল প্রোটোকলের ৭৯ নম্বর আর্টিকেল উল্লেখ করে যে, সমস্ত সাংবাদিক যারা “সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিপজ্জনক পেশাগত মিশনে নিয়োজিত, তাদের বেসামরিক হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং তাদের সুরক্ষিত রাখা হবে] এবং সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত যুদ্ধ প্রতিবেদকদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ না করে।
” আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত, ১৭৪ টি দেশ অতিরিক্ত প্রোটোকল অনুমোদন করেছে।উল্লেখযোগ্যভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান এবং পাকিস্তান ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭৭-এ প্রটোকল স্বাক্ষর করেছিল, কিন্তু এটি অনুমোদন করেনি। উপরন্তু, ইজরায়েল, ভারত এবং তুরস্ক এই চুক্তিতে স্বাক্ষর বা অনুমোদন করেনি। অতএব, ইজরায়েলের কোনো দায় নেই প্যালেস্টাইনে সশস্ত্র হামলা চালানোর সময় কর্তব্যরত সাংবাদিকদের রক্ষা করার। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় সাংবাদিকদের হত্যার সংখ্যা মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন।
গাজার যুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা ১৯৯০-এর দশকের যুগোস্লাভিয়ার সংঘাতের তুলনায় বেশি সংখ্যক সাংবাদিক তাদের জীবন হারিয়েছেন।আন্তর্জাতিক আইনের এই বিধানগুলি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, ইজরায়েলি সেনাবাহিনী গত ১৫ মাস ধরে প্যালেস্টাইনে সাংবাদিকদের হত্যার এক রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়েছে। গাজা সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজায় ২০১ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। অন্য সূত্রগুলি এই সংখ্যা ২১৭ বলে উল্লেখ করেছে।
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস‘ (সিপিজে)-এর তথ্য অনুসারে, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত গাজা এবং দখলকৃত পশ্চিম তীরে ১৩৮ জন প্যালেস্টাইনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।প্যারিস-ভিত্তিক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস‘ ইজরায়েলের সাংবাদিক হত্যাকে “অভূতপূর্ব রক্তস্নান” হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং প্যালেস্টাইন কে “সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সিপিজেও ইসরায়েলকে অন্যতম “সাংবাদিকদের কারাবন্দী করার শীর্ষ দেশ” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ইজরায়েল শুধুমাত্র কোনো প্যালেস্টাইনি সাংবাদিককে সুরক্ষিত হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায় না, বরং বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ করতেও বাধা দেয়।গাজার সাংবাদিকরা সংঘাত-এর সংবাদ সংগ্রহ করার সময় বিশেষভাবে উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হন। এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ধ্বংসাত্মক ইজরায়েলি বিমান হামলা, দুর্ভিক্ষ, গাজার ৯০% জনগণের বাস্তুচ্যুতি এবং ৮০% ভবনের ধ্বংস।
এছাড়াও, সাংবাদিক হত্যার প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য বলা যেতে পারে, ২০২৩ সালের শুরুতে গাজায় প্রায় ১,০০০ সাংবাদিক কাজ করছিলেন, তাই মৃত্যুর হার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। অবশ্য এই যুদ্ধের সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতিও ভয়াবহ।গাজায় কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের যুদ্ধের ফলে নিহতের সংখ্যা সংশোধন করে ৬১,৭০৯ জন বলে জানিয়েছে, এতে সেই হাজারো নিখোঁজ ব্যক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের এখন মৃত বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
গাজা সরকারের তথ্য অফিসের প্রধান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংঘর্ষে নিহত ফিলিস্তিনিদের ৭৬ শতাংশের মরদেহ উদ্ধার করে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এখনো অন্তত ১৪,২২২ জন ধ্বংসস্তূপের নিচে বা এমন এলাকায় আটকা পড়ে আছেন, যেখানে উদ্ধারকারীদের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে অন্যান্য পেশাগত গোষ্ঠীর তুলনায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি।এত বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করা জটিল, তবে কিছু কারণ উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) অত্যাধুনিক নজরদারি সরঞ্জামে সজ্জিত, যেমন পেগাসাস, যা মোবাইল ফোনে গোপনে প্রবেশ করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেয়। এছাড়া, লক্ষ্য বাছাই ও অস্ত্র ব্যবস্থার প্রোগ্রামিংয়ের জন্য তাদের এআই-চালিত “ল্যাভেন্ডার” এবং “গসপেল” সিস্টেম রয়েছে। এছাড়া, তাদের কাছে প্রাণঘাতী ড্রোনের একটি বহরও রয়েছে।যা সাংবাদিকদের নিয়মিত টার্গেট করে চলেছে।
গত বছর আগস্ট মাসে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট (আইপিআই) সহ ৬০ টি বৈশ্বিক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকাররক্ষা সম্পর্কিত সংস্থাগুলি ইজরায়েলের ক্রমবর্ধমান মিডিয়া স্বাধীনতা লঙ্ঘন এবং সাংবাদিকদের হত্যার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন -ইজরায়েল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি স্থগিত করার এবং দায়িত্বশীল ইজরায়েলি কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছিল।যদিও তাতে বিশেষ কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু তার থেকেও অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম ইজরায়েলের এই নিষেধাজ্ঞা বা সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদ করেছে।
গত ১৫ মাসে আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে কোনো দাবি জানায়নি।যদি কোনো প্রধান মিডিয়া সংস্থাকে কোনো স্থানে প্রবেশাধিকার দেওয়া না হয়, তবে প্রতিবাদ হিসেবে সেই নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ প্রায়শই সংবাদ প্রতিবেদনে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু গাজার ক্ষেত্রে, বিশেষত পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়া ইজরায়েলকে ছাড় দেয়, এবং তেল আভিভের প্রেস রিলিজগুলিকে প্রায়ই সত্য হিসেবে প্রচার করা হয়।
এই নির্লিপ্ততা ইসরায়েলকে বাস্তবের বিকৃত ব্যাখ্যা এবং তার দাবি প্রচার করতে সুযোগ দিয়েছে যে এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ, যা “বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী” দ্বারা আন্তর্জাতিক আইনের সীমার মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে।যদিও জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা, কিছু ইজরায়েলি এনজিও যেমন বিটসেলেম (দ্য ইজরায়েলি ইনফরমেশন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ইন দ্য অকুপায়েড টেরিটোরিস) এবং প্রধান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে, তবুও প্রথাগত মিডিয়া ইজরায়েলকে সুবিধা দিয়ে চলেছে।
ইজরায়েল নিজেকে “মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতন্ত্র” বলে দাবি করে, সাংবাদিকদের নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে, তার একটি কারণ হলো ইজরায়েল কখনোই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি হয়নি। ২০২২ সালে জেনিনে প্যালেস্টাইনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর হত্যাকাণ্ড একটি উদাহরণ।
যদিও পশ্চিমা মিডিয়া তার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কাভারেজ এবং তদন্ত করেছে, তবুও ইজরায়েল এই দাবি করে পার পেয়ে যায় যে, এটি ছিল একটি “খারাপ আপেল”-এর কাজ এবং দায়ী সৈনিককে জবাবদিহি করা হবে। কিন্তু তাকে জবাবদিহি করা হয়নি। সাংবাদিকদের গণহত্যাকে স্বাভাবিক করার জন্য ইজরায়েলের এই প্রচেষ্টা শুধু প্যালেস্টাইনি সাংবাদিকদেরই হুমকির মুখে ফেলছে না। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে এমন ভয়াবহ আচরণকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়, তবে কোনো সাংবাদিক, তারা যেই পাসপোর্টই বহন করুক না কেন, নিরাপদ থাকবে না।
রাষ্ট্রসংঘের বিশেষজ্ঞরা সাংবাদিকদের হত্যার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, তারা “গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে অধিকৃত প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড, বিশেষ করে গাজায়, সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের অসাধারণ সংখ্যায় হত্যা, আক্রমণ, আহত এবং আটক করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করছে।” নিউইয়র্কে সিপিজে প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কার্লোস মার্টিনেজ দে লা সের্না বলেছেন, “গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকরা তাদের প্রতিবেদনের জন্য সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছেন – তাদের জীবন। সুরক্ষা, সরঞ্জাম, আন্তর্জাতিক উপস্থিতি, যোগাযোগের মাধ্যম বা খাদ্য ও পানীয় ছাড়াই, তারা এখনও বিশ্বকে সত্য জানাতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
” তিনি বলেছেন, “প্রতি বার একজন সাংবাদিক নিহত, আহত, গ্রেপ্তার বা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন, আর আমরা সত্যের কিছু অংশ হারাই। এই ক্ষতির জন্য দায়ীদের মুখোমুখি হতে হবে দুটি বিচারের, একটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এবং আরেকটি ইতিহাসের নির্দয় দৃষ্টির সামনে।” শুধুমাত্র এই বক্তব্যগুলি বা সাংবাদিকের উপর আক্রমণের পরিসংখ্যানগুলি কোন ভাবেই একমাত্র পরিস্থিতিগত প্রমাণ নয় যে ভয়াবহ কিছু ঘটে চলেছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিদেশি সংবাদদাতারা বারবার রাফা ক্রসিং(ইজিপ্ট এবং প্যালেস্টাইনের গাজা স্ট্রিপের মধ্যে একমাত্র ক্রসিং পয়েন্ট) দিয়ে প্রবেশের অনুমতি চেয়েছেন যাতে নিজেরা ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করতে পারেন, কিন্তু তাদের প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। জেরুজালেমের ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে,“ইজরায়েল কখনোই এত দীর্ঘ এবং কঠোর তথ্য প্রতিরোধ আরোপ করেনি।
তারা আমাদের বারবার প্রবেশের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে, এমনকি আদালতে লড়াই করে এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে।” একই সময়ে, ইজরায়েলি দৈনিক পত্রিকা ‘হারেৎজ ‘ তাদের নিজ সরকারের দ্বারা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে এবং কাতারের টেলিভিশন চ্যানেল ‘আল জাজিরা‘ কে ইসরায়েল এবং পশ্চিম তীরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই প্রচারের সবচেয়ে গভীর প্রভাব অবশ্যই গাজায় অনুভূত হচ্ছে, তবে স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর এমন আক্রমণ সারা বিশ্বেই প্রভাব ফেলছে।
এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের ইজরায়েলের পক্ষে অজুহাত দেওয়া বন্ধ করার এবং তার কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার। সাংবাদিকদের জন্য সময় এসেছে তাদের প্যালেস্টাইনি সহকর্মীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার এবং যারা তাদের গণহত্যা করেছে তাদের জবাবদিহি দাবি করার। সময় এসেছে তারা তাদের সরকারের কাছ থেকে এমন পদক্ষেপ দাবি করার, যা সরাসরি ইজরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। (শেষ)