কৃষিহাইলাইটস

একজন কৃষকে নূর মোহাম্মদের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার কাহিনি

২০টি নতুন জাতের ধান আবিষ্কার করেছেন তিনি। সেগুলো উচ্চফলনশীল, চাষ হচ্ছে মাঠে। এ সবই তিনি শিখেছেন নিজে নিজে। শিখেছেন, কীভাবে সংকরায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা যায় নতুন ধান। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে। স্বশিক্ষিত এক কৃষকের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর কাহিনি

কৃষকবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ
কৃষকবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ

আপন চেষ্টায় হয়ে উঠেছেন স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী। গত ৬ থেকে ১০ নভেম্বর তিনি মালয়েশিয়ায় কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যোগ দেন।দেশে নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে ‘কৃষিতে উচ্চফলন’ ক্যাটাগরিতে জাতীয় কৃষি পদক (সোনা) পেয়েছেন। এই কৃষকের নাম নূর মোহাম্মদ। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামে।

নূর মোহাম্মদ যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাঁর মা মারা যান। আর যখন পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠেন, তখন তাঁর বাবা মারা যান। নানি তাঁকে মানুষ করেছেন। তাঁর মনে আছে, ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। বাবার ধান চাষ দেখে তিনি বাড়ির পাশে ছোট্ট একটু জমিতে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ছোট একটি প্লট তৈরি করতেন। সেখানেই বাবার মতো করে ধান রোপণ করতেন, পরিচর্যা করতেন। ধান পাকলে কেটে মাড়াই করতেন। তখন খরাপীড়িত বরেন্দ্র অঞ্চলের ধান নষ্ট হয়ে যেত। ফলন ভালো হতো না। এ জিনিসটা ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে দাগ কাটে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বরেন্দ্র ভবনে কৃষকদের একটা প্রশিক্ষণ কর্মশালা হয়েছিল। তখন তিনি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। ওই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবদুল মজিদ। সেখানে গিয়ে নূর মোহাম্মদ নতুন জাতের ধান সম্পর্কে ধারণা পান। তাঁরা নতুন জাতের ধানের বীজ দিলেন। নূর মোহাম্মদ দেড় বিঘা জমিতে সেই ধান চাষ করলেন। ভালো ফলন হলো। পাশাপাশি দেখা গেল, গ্রামের সাধারণ চাষিদের তাঁর মতো ফলন হয়নি।

এভাবে প্রতি মৌসুমে তিনি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে যান। প্রতিবার পুরোনো বীজ গ্রামের চাষিদের দিয়ে তিনি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে নতুন বীজ এনে রোপণ করেন। এভাবে গবেষণাকেন্দ্রের মতো প্রতিটি ধানের জন্য ছোট ছোট করে প্লট তৈরি করেন। প্রতিটি প্লটে সাইনবোর্ড দিয়ে ধানের নম্বর লিখে দেন। গবেষণালব্ধ ধানের বীজ দিয়ে প্লট তৈরি করে তিনি তার নাম দিলেন ‘শস্য মিউজিয়াম’। এই খবর প্রথম আলোয় ছাপা হয়। ধান গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা তাঁর প্লট দেখতে আসতেন। এসব দেখে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধান গবেষণাগারের বীজ দিয়ে তাঁদের মতোই প্লট তৈরি করা দেখে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাইনবোর্ডের যে খরচ হতো, তা দিয়ে দিতেন। শুধু সাইনবোর্ডের দোকান থেকে রসিদ নিয়ে আসতে হতো। তাঁরা গবেষণার মাঠের মতোই নূর মোহাম্মদের মাঠকে গুরুত্ব দিতেন। তখন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রেজাউল করিম তাঁর মাঠ দেখতে যেতেন।

ব্রি-৩৯ ধান তখনো জাত হিসেবে বাজারে আসেনি। নূর মোহাম্মদ গবেষণাগার থেকে এনে আমন মৌসুমের জন্য ওই ধানের বীজ রোপণ করেন। মাঠে ইঁদুর লেগে ধান খেয়ে নিল। অল্প কিছু ধান হলো। আমনের জাত হলেও তিনি সেই ধান বোরো মৌসুমে আবার রোপণ করেন। কিন্তু বোরোতেও ভালো ফলন হলো। সেই বছর ব্র্যাক একটি হাইব্রিড জাতের বীজ তাঁকে দেয়। দুই ধান পাশাপাশি চাষ করেন। প্রস্তাবিত জাত ৩৯-এর ফলন ভালো হলো। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাঠেও ভালো হলো। পরের বছরই ব্রি–৩৯ ধান জাত হিসেবে বাজারে আসে।

নূর মোহাম্মদ রাজশাহী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাঠে গিয়ে বসে থাকতেন। দেখতেন, বিজ্ঞানীরা কীভাবে একটি প্রস্তাবিত জাত তৈরি করছেন। একটি মাতৃ গাছের সঙ্গে পিতৃকুলের কীভাবে সংকরায়ণ ঘটান। দেখতে দেখতে তিনি কিছুটা কৌশল আয়ত্ত করেন। যেটুকু বুঝতেন না, বিজ্ঞানীরা তাঁর আগ্রহ দেখে বুঝিয়ে দিতেন। এরপর তাঁর মাটির ঘরটি হয়ে ওঠে গবেষণাগার।

নূর মোহাম্মদ জেনে গেছেন, কখন প্রাকৃতিকভাবে পরাগায়ন ঘটে, তা তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে পরাগায়ন ঘটে। এই সময় সদ্য শিষ বের হচ্ছে, এমন গাছের ধানের মুখ ফাঁক হয়ে যায়। তখন সেই ধানের ওপরে ছয়টি পরাগদণ্ড থাকে, এগুলো পুরুষ। বাতাসে দোল খেলেই পুরুষ পরাগরেণু নিচে ঝরে পড়ে। নিচে থাকে ওভারি বা মাতৃকুল। এর সঙ্গে পরাগরেণুর মিলনের ফলে ধান হয়। এই মিলন না হলে সেই ধানে চিটা হয়ে যায়।

বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে এই কাজ কৃত্রিমভাবে করেন। তাঁরা আগে ধানের পিতৃকুল ও মাতৃকুল ঠিক করে নেন। একটি মোটা চালকে যদি সরু করতে চান, তাহলে মোটা চাল যে ধান থেকে হয়, সেই ধানের গাছটিকে মাতৃ গাছ হিসেবে নেন। সরু চালের ধানগাছটি পিতৃকুল হিসেবে নেন। মাতৃকুলের গাছটি টবে নিতে হয়। সংকরায়ণ করার আগের দিন বেলা তিনটার দিকে টবের গাছের সদ্য বের হওয়া ধানের এক-তৃতীয়াংশ কেটে ধানের ছয়টি পুরুষ পরাগদণ্ড ফরসেফ দিয়ে বের করে ফেলে দেওয়া হয়। এবার কাটা ধানটাকে গ্লসি পেপার দিয়ে জড়িয়ে জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখতে হয়। পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই পিতৃকুলের, অর্থাৎ সরু চালের ধানের গাছের শিষ একটু নিচের দিক থেকে কেটে আনতে হয়। এই শিষের পরাগরেণু যাতে শুকিয়ে না যায়, সে জন্য কেটে আনা ধানগাছটা পানি বা কাদামাটিতে পুঁতে রাখতে হয়। পরাগায়নের সময় হলে গ্লসি পেপার খুলে কাটা ধানের ওভারি উন্মুক্ত করে এর ভেতরে পুরুষ গাছের পরাগরেণু ঝরিয়ে দিতে হয়। আবার একইভাবে গ্লসি পেপার দিয়ে জড়িয়ে রাখতে হয়। পরে এই কাটা ধানটিই পাকে। এর সঙ্গে খোসা থাকে না। শুধু চাল থাকে। এই চাল গবেষকেরা শুকিয়ে রাখেন। এটাকে তাঁদের ভাষায় ‘এফ-ওয়ান’ বলা হয়। অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের সংকরায়িত প্রজাতি।

পরে রোপণ মৌসুমে ওই চালই রোপণ করেন গবেষকেরা। তখন চাল থেকে নতুন গাছ গজায়। এই গাছ থেকে নতুন যে ধান হয়, তাকে গবেষকদের ভাষায় বলা হয় ‘এফ-টু’। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের সংকরায়িত প্রজাতি। এই ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর পরের বছর আবার রোপণ করে যে ধান পাওয়া যায়, তাকে ‘এফ-থ্রি’ বা তৃতীয় প্রজন্মের সংকরায়িত প্রজাতি বলা হয়।

এরপর প্রাথমিক ফলন পরীক্ষার পালা। আরেকবার চাষ করে দ্বিতীয়বার ফলন পরীক্ষা করা হয়। তার পরের বছর আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন এলাকায় চাষ করে ফলন পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা হয়, কোন এলাকায় কেমন হলো। রোগবালাই হচ্ছে কি না। তার পরের বছর যে সারির ফলন ভালো হয়, তার ফলন পরীক্ষা করা হয়। তাকেই বলা হয় অগ্রগামী সারির ফলন পরীক্ষা। পরের বছর চাষ করে আবার ফলন পরীক্ষা করা হয়। এবার ধানের ফুল আসার সময় একবার ও পাকার সময় আরেকবার পরীক্ষা করা হয়। ফুল আসার সময় বীজ বোর্ডের কমিটির সদস্যরা পরিদর্শন বইয়ে ফলাফল লিখে রাখেন। পাকার সময় তাঁদের সামনেই কর্তন ও মাড়াই করা হয়, যাতে তাঁরা জানতে পারেন কত দিনে ধান পাকল। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ আছে কি না। এই পরীক্ষাকে বলা হয় প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষা (পিভিটি)।

এরপর জাত হিসেবে স্বীকৃতির জন্য বীজ বোর্ডে পাঠানো হয়। পিভিটি করার সময়ই জাতীয় বীজ বোর্ডের কাছে এক হাজার টাকা ফি দিয়ে দরখাস্ত করতে হয়। তারা ১০ জায়গায় এই ধান চাষ করে দেখে। প্রতি জায়গায় চাষ করার জন্য ৩২ হাজার টাকা করে মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা একসঙ্গে জমা দিতে হয়। জাত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগপর্যন্ত উদ্ভাবিত নতুন ধানকে বলা হয় ‘কৌলিক সারি’। নূর মোহাম্মদ এভাবে প্রায় ২০০ কৌলিক সারি উদ্ভাবন করেছেন, কিন্তু টাকার অভাবে তিনি বীজ বোর্ডে আবেদন করতে পারেননি। তিনি মনে করেন, তার পাঁচটি কৌলিক সারি জাত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button