ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এক মাস আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে পড়ে, তা থেকে জাতিকে বের করে আনতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন ধরে দেশে মামলা-মোকদ্দমা আর নানা আইনি জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ড. ইউনূসকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষতবিক্ষত দেশেরই হাল যখন তাকে ধরতে হয়েছে, তখন সেটিকে অভূতপূর্ব বললে ভুল বলা হবে না।
অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধ মত হিসেবে বিবেচিত ড. ইউনূসের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কারাবরণ অপেক্ষা করছে। তবে ৮ আগস্ট প্যারিস থেকে দেশে ফিরে বীরের সংবর্ধনা পেয়েছেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে গ্রহণ করেছেন দেশের শাসনভার। অপরদিকে, তাকে দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের মুখে ঠেলে দেওয়া শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মুখে এর তিন দিন আগেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
অভ্যুত্থান ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে বেছে নেন। তিনি এই পদ গ্রহণ করতে রাজি হলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এভাবেই অর্থনীতির অধ্যাপক থেকে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হন ড. ইউনূস। তার ফিরে আসার মধ্য দিয়ে দেশ চার দিনের নেতৃত্বশূন্য পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন, যেখানে তার বক্তব্যে দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পায়। তিনি দেশবাসীকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ উপভোগ ও উদযাপনের আহ্বান জানান। তার প্রতি ভরসা রাখার অনুরোধ করেন ও সমগ্র জাতিকে এই নজিরবিহীন সংকটের মাঝে একতাবদ্ধ থাকার বার্তা দেন। ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় এক আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের কথা স্মরণ করে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি তিনি। যেমনটা ভাবা হয়েছিল, প্রথম কয়েকটি দিন বাংলাদেশের পুনর্জন্ম ও বিরূপ সময় কাটিয়ে ওঠার বার্তা ও এর প্রকাশেই কেটে যায়। তবে, বাংলাদেশের পুনর্জন্ম এবং পুনরারম্ভে তার সুচিন্তিত শব্দচয়ন মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
এরপরই আসে সবচেয়ে কঠিন সময়। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভের পর ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশের মনোবল এখনো পুরোপুরি ফেরেনি। এরই মধ্যে পুলিশ প্রশাসনে এসেছে বড় রদবদল। কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই এখনো কাজে ফেরেননি অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে আশেপাশে কোনো সমস্যা দেখলেও তারা দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক। হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রতিহিংসামূলক আক্রমণের শিকার হয়েছে পুলিশ, যদিও এ ধরনের ঘটনা এখন কমে এসেছে। তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও হত্যা মামলা হওয়ার বিষয়টি এখনও বড় উদ্বেগের কারণ। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে, কারণ বেশ কিছু মহল এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ড. ইউনূস গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থাগুলোতে বড় আকারে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছেন যাতে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন। একইসঙ্গে, তিনি আরেকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদকে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলের সুবিস্তৃত দুর্নীতি বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতিতে এখনো নানা সমস্যা থাকলেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
উপদেষ্টাদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মানুষের ভরসা ফিরিয়ে আনা ও বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কার্যকর অর্থনৈতিক নীতিমালা ও সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন। ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের শাসনামলের পর গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি’র মধ্য দিয়ে গেছে এবং কোটি মানুষ দারিদ্র্যতা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। এর পেছনে বড় অবদান ছিল তৈরি পোশাক খাতের। তবে করোনাভাইরাস মহামারি থেকে উত্তরণের পর থেকে দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে পড়ে। বিশেষত, খাবারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় চরম ভোগান্তির শিকার হয় দেশবাসী।
এই বিষয়গুলোর জন্য দুর্নীতি ও সরকারি অব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। রাজনৈতিক কারণে হাসিনা প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কারে অনীহা দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়েছে। তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা তাদের অর্ডার বাতিল করেছেন। এ বিষয়টির দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ড. ইউনূসের জন্য অন্যতম প্রাধান্যের বিষয় হওয়া উচিত নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা, যাতে পরবর্তী নির্বাচনগুলোকে ঘিরে মানুষের আস্থার জায়গা ফিরে আসে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সংসদ সরকারের আজ্ঞাবহ একটি নামসর্বস্ব সংস্থায় পরিণত হয়। নাগরিক সেবাদাতা সংস্থাগুলো ও বিচারবিভাগেও বড় আকারে রাজনীতিকরণ করা হয়। কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে। দ্য ক্রাইসিস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘আগের তুলনায় উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় কয়েকটি সংস্থা খুব দ্রুত কার্যকর হয়ে উঠলেও বাকিগুলো পরাধীনতার ক্ষত থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘ সময় নেবে।’
ড. ইউনূসের জন্য ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ৮ আগস্ট তিনি যোগ্য, কিন্তু দেশ শাসনে অনভিজ্ঞ একদল মানুষকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেন। দ্রুত জনপ্রশাসন, পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে (ডিজিএফআই) পরিবর্তন আনেন। এই সংস্থা ও বাহিনীগুলোকে কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনা এক ধরনের ভয়-ভীতির সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। হাসিনার প্রশাসনের আওতায় এই বাহিনীগুলো ছিল একেবারেই দায়মুক্ত। রাজনৈতিক কারণে আর গ্রেপ্তার, গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেতে হবে না—মানুষের মনে এ আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে ড. ইউনূসকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।
ড. ইউনূসের জন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো, বাংলাদেশের মানুষের আশা ও প্রত্যাশাকে মাথায় রেখে পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানিয়ে চলা। প্রথাগতভাবে হাসিনার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে বিবেচিত ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।
মূলত, হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ঢাকার ক্রমাগত অনুরোধেই সম্পর্কের এই অবনতি। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, হাসিনা নয়াদিল্লিতে থাকার কারণে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না। তবে এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে মাথায় রাখতে হবে যে ভারত প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতিও বদলে যাচ্ছে। যার ফলে, যথোপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেই ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে এবং সার্বিকভাবে, বৈদেশিক সম্পর্কে আরও ভারসাম্য আনতে হবে।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, ‘শাসক হিসেবে তিনি (হাসিনা) যে জনপ্রিয় ছিলেন না, তা স্পষ্ট ছিল। তা সত্ত্বেও প্রশাসনকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশিদের কাছে ভারত তার ভাবমূর্তি হারিয়েছে। এখন তাদেরকে (বাংলাদেশের) সংস্কারের পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছে মানুষ। আগামীতে ভারত-বিরোধী আবেগ আরও বাড়বে, যা দুই দেশের প্রতিবেশীসূলভ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’ ভারতের উচিত অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের অংশ হিসেবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে সুসম্পর্ক তৈরি করা। অন্তর্বর্তী সরকারের আরও অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো, দেশের নাগরিকরা বেশ কয়েকটি বিষয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রয়েছে। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ এবং পরবর্তীতে, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। আপাতত নতুন প্রশাসন ‘সকল পক্ষের প্রত্যাশা পূরণের’ চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। গণবিক্ষোভে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে—দেশের সাধারণ মানুষ প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, উন্নয়ন অংশীদার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আরও স্থিতিশীল একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির জন্য সংস্কার কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হতে পারে ২০১১ সালে হাসিনা প্রশাসনের বাতিল করে দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবারও চালু করা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হতে পারে। এতে আবারও নতুন করে কোনো স্বৈরাচারী সরকার ফিরে আসার ঝুঁকি কমতে পারে। হাসিনার বিদায়ে পক্ষপাতদুষ্ট, একপাক্ষিক শাসন ব্যবস্থা থেকে সরে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সংস্কৃতি গত তিন দশকে বাংলাদেশের রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। আগের ভুলগুলোকে শোধরানোর এটাই সুযোগ।