১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফারাক্কা ব্যারাজ উদ্বোধন করে ভারত। এ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা ছিল বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীরও। তখন পানিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। তবে সরকারের সিদ্ধান্তেই ওই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত অংশগ্রহণ করেননি। এর মূল কারণ ছিল ফারাক্কা ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষ। বাংলাদেশের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তির আগেই ব্যারাজটি চালু করে দেয় ভারত, যা ওই সময় দেশে বড় ধরনের অসন্তোষ তৈরি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এরপর পার হয়েছে প্রায় ৪৯ বছর। এখনো বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে চাপে ফেলার বড় এক ক্ষেত্র হয়ে আছে ফারাক্কা ব্যারাজ তথা গঙ্গার পানি বণ্টন।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার পানি রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রামিজ মোহাম্মদ ভাট। তিনি তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, চূড়ান্ত চুক্তির আগেই ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করে দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে ভারতের প্রতি একটি বিরূপ মনোভাব তৈরি করে। এর জেরে ওই সময়ে যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী দলে ছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকেও জটিলভাবে দেখতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির বাস্তবায়নও হুমকির মুখে পড়ে যায়। একই সঙ্গে ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার পানি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতা তার প্রতি বিরোধীদের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দেয়, যা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেও প্রভাব রেখেছিল।
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই একটা দ্বন্দ্ব চলছিল, যা পরবর্তী সময়ে আরো প্রকট হয় এবং ভারতবিদ্বেষী মনোভাব গড়ে ওঠে। বিগত কয়েক দশকে সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে ভারতের ভূমিকা ভারতের প্রতি জনগণের নেতিবাচক ধারণা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ভারতের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে তারা শুধু নিজের স্বার্থই বিবেচনা করে এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কার্যত তারা কোনো ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি বণ্টনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। বাংলাদেশ-ভারতের তৎকালীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জেরে সবার প্রত্যাশা ছিল শিগগিরই দু্ই দেশ একটি গ্রহণযোগ্য পানি বণ্টন চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবে। তবে সে প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটেনি। ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে কংগ্রেসের পরিচিতি থাকলেও গঙ্গার পানি বণ্টনে দলটির ভূমিকা ছিল অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
স্বাধীনতার পর থেকে ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে মোট পাঁচটি চুক্তি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নিয়ে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশে পানি বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পরই ফারাক্কা চালু হবে। এরপর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দুই দেশের বেশ কয়েকটি বৈঠক হলেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধের জেরে পানি বণ্টনের বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। তবে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতকে ২ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪০ দিনের জন্য পানি উত্তোলনের বিষয়ে সম্মত হয়েছিল বাংলাদেশ। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত প্রতি ১০ দিনে গঙ্গা থেকে ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি উত্তোলন করবে এবং অবশিষ্ট ৩৯ হাজার থেকে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তি হওয়ার আগেই ব্যারাজ পুরোপুরি চালু করে ভারত এবং ৪০ দিনের চুক্তি শেষ হওয়ার পরও গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে। এমনকি পানি উত্তোলনের পরিমাণও আগের তুলনায় বাড়ানো হয়।