জেলার খবরহাইলাইটস

প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

বন্যায় ১১ জেলার ৪৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত * মৃত্যু বেড়ে ১৫ * কাল পর্যন্ত বৃষ্টির আভাস

নতুন এলাকাদেশের বন্যাকবলিত ১১ জেলার কোথাও কোথাও পানি কিছুটা কমেছে। কিন্তু যতগুলো স্থানে কমেছে, তার চেয়ে বেশি এলাকা গতকাল প্লাবিত হয়েছে। ফেনীতে প্লাবিত হয়েছে সোনাগাজী উপজেলা। এর মধ্য দিয়ে জেলার সব উপজেলাই স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার রূপ দেখল। পাশের জেলা কুমিল্লায় গোমতী নদীতে রেকর্ড পরিমাণ পানি বাড়ায় প্লাবিত হয়েছে বুড়িচং উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন। বন্যা বিস্তৃত হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও ফটিকছড়িতেও। ভাঙনের কারণে একই পরিস্থিতি মৌলভীবাজারেও। সব মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত ১১ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৮ লাখ। এ ছাড়া গত চারদিনে সাত জেলায় মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। এদিকে বন্যার পূর্বাভাস নিয়ে বিপরীতধর্মী তথ্য এসেছে সরকারের দুই প্রতিষ্ঠান থেকে। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, আজ থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসবে এবং বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। আর আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী সোমবারের আগে দেশে বৃষ্টিপাত কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অফিসের বরাত দিয়ে দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে আজও ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ত্রিপুরায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার অবনতি ঘটে মঙ্গলবার থেকে। এর আগে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় লঘুচাপ। এর প্রভাবে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে থাকে। মঙ্গলবার থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, খাগড়াছড়িসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয়। বৃষ্টির পানির সঙ্গে যুক্ত হয় ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। পূর্ণিমার কারণে গত কয়েক দিন জোয়ারের সময় পানির উচ্চতাও ছিল অস্বাভাবিক। সবকিছু মিলিয়ে ১১ জেলায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। এ তালিকায় রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল রাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১১ জেলার ৭৭ উপজেলার ৫৮৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আকস্মিক এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪৮ লাখ ২৭ হাজার ৪৯৯ জন। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৫।

প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, মঙ্গলবার থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের সাত জেলায় ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় চার, চট্টগ্রামে চার, কক্সবাজারে তিন এবং ফেনী, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মারা গেছেন।

বন্যার প্রভাব পড়েছে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কেও। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকার প্রায় দেড় হাজার মোবাইল টাওয়ার গতকাল বিকাল পর্যন্ত অচল ছিল। এর মধ্যে ফেনীতে অচল ছিল প্রায় ৯২ শতাংশ টাওয়ার। এছাড়া গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন ছিলেন বন্যাকবলিত জেলাগুলোর প্রায় ১১ লাখ গ্রাহক। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী। গতকাল পর্যন্ত এ জেলার পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। কারণ তিনদিন ধরে ফেনী কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এ জেলার সব উপজেলায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। সর্বশেষ বন্যার কবলে পড়ে সোনাগাজী। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে স্বেচ্ছাসেবীদের বেগ পেতে হচ্ছে।  ফেনীতে দুইদিন ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট নেই। ফলে গ্রামে আটকে পড়া পরিবারের খোঁজ নিতে পারছেন না স্বজনরা। স্থানীয়রা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে কখনো দেখেননি তারা। বিশেষ করে শহরে পানি উঠে যাওয়ার ঘটনায় তারা অবাক হয়েছেন। ফেনীতে বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে।

ফেনীর পাশের জেলা কুমিল্লায় গতকাল প্লাবিত হয় বুড়িচং উপজেলা। বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় জেলা সদরের সঙ্গে।  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার জানান, ষোলনল, পীরযাত্রাপুর, বুড়িচং সদর, বাকশিমূল ও রাজাপুর ইউনিয়নের অন্তত ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। কুমিল্লা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুর রহমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত ১টার সময় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। গতকাল ভোর ৬টায় ছিল ১২৯ সেন্টিমিটার ওপরে।’ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে ১৯৯৭ সালে গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। এরপর আর এত পানি দেখা যায়নি।

লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলায় বন্যার পানি বেড়েছে। পানি বেড়েছে জেলা শহরেও। ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ উপজেলা হলো লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর, রামগতি, রায়পুর ও রামগঞ্জ। সদরের চাঁদখালি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘১৯৯৮ সালের বন্যা দেখেছি, কিন্তু এতটা ভয়াবহ ছিল না। সকালে যেখানে হাঁটু পানি ছিল, বিকালে সেখানে কোমর সমান পানি।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় হাওড়া নদীর পানি ৯ সেন্টিমিটার কমেছে। ফলে আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মনজুর রহমান। পানি কিছুটা কমলেও আখাউড়া-আগরতলা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমও।  চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক গ্রাম। তবে মুহুরী প্রকল্পের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।  মিরসরাই উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ফেনী নদীর পানি বাড়তে থাকায় এ উপজেলার অনেক ইউনিয়ন প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের সাতটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে ফটিকছড়ি উপজেলায়ও। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, বন্যায় পানির উচ্চতা বাড়েনি। কিন্তু নতুন করে অনেক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উপজেলার প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭০৬টি। ২ লাখ ৬২ হাজার ৪০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যায় মিরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলার ৫৯০ কিলোমিটার সড়ক ও ১২৫টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলায় পানি অনেকটা কমে গেছে। এতে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে দীঘিনালার কবাখালী সড়কে। তবে উপজেলার মেরুংয়ের কিছু এলাকা গতকাল সন্ধ্যায়ও নিমজ্জিত ছিল।  আরেক পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলায় নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি।  নোয়াখালীতেও বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গতকাল অনেক এলাকায় পানি কমতে শুরু করে। তবে সদর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও সুবর্ণচর উপজেলার অধিকাংশ এলাকা গতকাল পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত ছিল।

হবিগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা। খোয়াই নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জালালাবাদ এলাকায় নদীভাঙনের ফলে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ২৫টি গ্রাম। এর বাইরে বাহুবল, চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মৌলভীবাজারের কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে জেলার কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদীর প্রায় ১৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়ায় অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।  এদিকে ভারতের ত্রিপুরায় চারদিনে বন্যায় অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে গেছে। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অংশে আজও ভারি অথবা অতিভারি বৃষ্টি হতে পারে। রাজ্যের আট জেলায় জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। টানা চারদিনের বৃষ্টিতে ত্রিপুরার ধলাই, খোয়াই, দক্ষিণ ত্রিপুরা, পশ্চিম ত্রিপুরা, উত্তর ত্রিপুরা ও উনকোটি জেলার সব নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

এমন আরো সংবাদ

Back to top button