রাজধানীর লেকশোর হোটেলে চলতি মাসে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপ অনুষ্ঠানে এনবিআরের পক্ষ থেকে দেয়া এক উপস্থাপনায় দাবি করা হয়, মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার ও মোবাইল ফোনের মতো উৎপাদনমুখী শিল্পে নীতিগত ধারাবাহিক সহায়তা নিশ্চিত করার ফলে এসব পণ্যের বাজার এখন দেশীয় উৎপাদনকারীদের দখলে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনকারী দেশী-বিদেশী ব্র্যান্ডের দখলে মোটরসাইকেল বাজারের ৯৫ শতাংশ। ফ্রিজের বাজারে এ হার ৯০ শতাংশ। এছাড়া এসি ও মোবাইল ফোনের বাজারের যথাক্রমে ৮৫ ও ৬৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারীদের দখলে।
এসব পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে মান বিবেচনায় দেশে তৈরি ইলেকট্রনিক পণ্য ও বিদেশে তৈরি পণ্যের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানের দিক থেকে দেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশী পণ্যের চেয়ে এগিয়ে। এসব পণ্য উৎপাদনে সরকারের দেয়া নীতিসহায়তাগুলো আরো দীর্ঘমেয়াদি হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো উৎপাদন সক্ষমতাকে আরো টেকসই করে স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি বাজারও সম্প্রসারণ করতে পারবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনসাধারণের আয় বাড়ায় দেশের বাজারে মোটরসাইকেলের চাহিদা এখন ক্রমেই বাড়ছে। স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোটরসাইকেলের বাজার থেকে কোম্পানিগুলোর রাজস্ব আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৯৩ কোটি ডলারের (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ২২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ)। কয়েক বছর আগে বেশ দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হলেও সাম্প্রতিক সময় পণ্যটির বাজার প্রবৃদ্ধি বেশ শ্লথ হয়ে এসেছে। ২০২৪ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে মোটরসাইকেলের বাজারে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে দশমিক ৬৪ শতাংশে। ২০২৮ সালের মধ্যে এর বাজারের আকার দাঁড়াতে পারে ১৯৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণে।
বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অটোমোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে আলাদা দুটি শিল্প নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে দুটি নীতিমালার আওতায় এনবিআর এসআরও দিয়েছে। সেখানে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যে কী করলে একটি পণ্যকে বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাকচারড বলে ধরে নেয়া হবে। এ নীতি সুবিধা ব্যবহার করে দেশে হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি, বাজাজ—প্রায় সবাই ফ্যাক্টরি ফ্যাসিলিটি স্থাপন করেছে। এরা সবাই নির্ধারিত মানদণ্ডে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ধারণাটি বাস্তবায়ন করছে। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে শুধু মোটরসাইকেল নয়, এর সঙ্গে ফ্রিজ, মোবাইল ফোন ও এসির মতো পণ্যের শিল্প-কারখানা স্থাপন হয়েছে।’
এ মুহূর্তে পর্যায়ক্রমে মূল্য সংযোজন বাড়ানোর মাধ্যমে এসব শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে উল্লেখ করে হাফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘গত পাঁচ-ছয় বছরে বাড়েনি। এখন নতুন দিকনির্দেশনার মাধ্যমে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যালু অ্যাডিশন আরো বাড়ানোর দিকে যেতে হবে। বিশেষ করে অটোমোবাইল খাতে দেশে উৎপাদিত পণ্যে ভ্যালু অ্যাডিশন বাড়ানোর জন্য নীতি বা দিকনির্দেশনার প্রয়োজন।’
বিভিন্ন পণ্যের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ের বাজারের পর্যালোচনার ভিত্তিতে নিয়মিত মার্কেট ইনসাইট প্রকাশ করছে স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইন্টেলিজেন্স। বৈশ্বিক ডাটাবেজটির বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটরের বাজারসংক্রান্ত পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, টেকসই পণ্য উৎপাদনে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ ও ভোক্তাদের মধ্যে প্রতিবেশ সচেতনতা বাড়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী রেফ্রিজারেটরের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটর বাজারে মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ (সর্বশেষ বিনিময় হার ১ ডলার=১১৭ টাকা ৩৫ পয়সা হিসাবে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা)। ২০২৪ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যটির বার্ষিক গড় বাজার সম্প্রসারণের হার দাঁড়াবে বার্ষিক ৫ দশমিক ১৮ শতাংশে। আর চলতি বছর শেষে খানাপিছু গড় রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে দশমিক ১০-এ।
বাংলাদেশে ফ্রিজ ও এয়ারকন্ডিশনারকে (এসি) উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি ওয়ালটন। প্রতিষ্ঠানটির এএমডি এসএম শোয়েব হোসেন বলেন, ‘সরকারের নীতিগত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েই দেশী শিল্প উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় এখন ফ্রিজ ও এসির মতো পণ্যগুলো উৎপাদন সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। এসব পণ্যের মূল্য সংযোজন ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশের বেশিও হয়। সরকারই বলে দিয়েছে যে স্থানীয় পর্যায়ে ম্যানুফ্যাকচারড বলতে গেলে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হতে হবে। এটাই সবাই অনুসরণ করছে। এসব কারণে সরকার, দেশ ও জনগণ উপকৃত হচ্ছে। সরকারের এসব সুবিধা অব্যাহত রাখাসহ ক্রমে আরো বাড়াতে হবে। যাতে স্থানীয় শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা আরো বাড়ে।’
একসময় দেশে এসিকে ধরা হতো বিলাসপণ্য হিসেবে। যদিও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারাবাহিকতায় এবং গ্রীষ্মকাল আগের চেয়ে তুলনামূলক বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় বাংলাদেশে এসির চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মধ্যে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এসির চাহিদা তুলনামূলক বেশি। স্ট্যাটিস্টার আরেক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের বাজার থেকে এসি কোম্পানিগুলো ২০২৪ সালে মোট ৯ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার ডলারের (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ১ হাজার ৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার বেশি) সমান আয় তুলে নিতে পারে। ২০২৯ সাল পর্যন্ত পণ্যটির বার্ষিক বাজার প্রবৃদ্ধির গড় হার দাঁড়াতে পারে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশে। আর ওই সময় নাগাদ বছরে গড় ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে বাজারে এসির সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৭০০টিতে।
এসির বাজারে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি ইলেকট্রো মার্ট গ্রুপ। দেশের চাহিদা পূরণ করে প্রতিষ্ঠানটি এখন বিদেশেও এসি রফতানির পরিকল্পনা করছে। কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. নুরুল আফছার বলেন, ‘বর্তমানে এ খাতের জন্য সরকারের নীতিমালা ইলেকট্রনিকস শিল্পে বিনিয়োগ ও কারখানা স্থাপনের জন্য যথেষ্ট অনুকূল বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রতি বছরই মেয়াদি কর অব্যাহতি বা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। যদি সেটি বছর মেয়াদি না করে দীর্ঘমেয়াদি করে দেয়া হয়, তাহলে এ খাতে আরো বিনিয়োগ বাড়বে। বছর মেয়াদি করহার নির্ধারণ করা হলে নতুন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে পারেন। বছর মেয়াদি হলে সবাই চিন্তা করেন আমি আগামী বছর এ সুযোগ-সুবিধা পাব কিনা। যদি না পাই তাহলে ব্যাংক ঋণ, সুদহার, ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা, ব্রেক ইভেনে আসা সবকিছু একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে দাঁড়ায়। সেজন্য সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে ২০২৪ সালে যেটা শেষ হয়ে যাবে, তা যেন দীর্ঘমেয়াদি করে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। পাশাপাশি শুল্ক নীতির সহজীকরণ ও রাজস্বনীতি ব্যবসাবান্ধব করারও প্রত্যাশা থাকবে।’
দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের বাজার সবচেয়ে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হতে দেখা গেছে ২০২২ সালে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানি ওই বছর মোট সেলফোন উৎপাদন করেছে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৭২ হাজারটি। ২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ২১ হাজারটি। এ দুই বছরেই স্মার্টফোনের তুলনায় বাজারে ফিচার ফোনের সরবরাহ বেশি করেছেন স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোন সরবরাহকারীরা। আর চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন হয়েছে ৬০ লাখ ৭৪ হাজারটি। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশের বেশি ফিচার ফোন। আর স্মার্টফোন প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজার নিয়েও স্ট্যাটিস্টার পর্যবেক্ষণ রয়েছে। স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের তথ্যমতে, বাংলাদেশে স্মার্টফোনে বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রধানতম অনুঘটকের ভূমিকা রাখছে উঠতি মধ্যবিত্ত। এ শ্রেণীর উত্থানসৃষ্ট বাজার ধরতে গিয়ে দেশী ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বিক্রির পরিমাণও। ২০২৪ সালে দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত স্মার্টফোনের বাজার থেকে কোম্পানিগুলোর মোট আয় হবে প্রায় ৬৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ৭৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ)। ২০২৪ থেকে ২০২৮ পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাজার থেকে কোম্পানিগুলোর এ রাজস্ব আয়ে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আগামী বছর (২০২৫ সাল) দেশে স্থানীয় পর্যায়ে স্মার্টফোন উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে।