বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের একজন হিসেবে আবারো স্বীকৃতি পেয়েছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক অধ্যাপক ড. এম এ হান্নান। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্বখ্যাত অ্যানালিটিক্স প্রতিষ্ঠান ‘ক্লারিভেট’, নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণার এবং ওয়েব অব সাইন্স টিএম-এর একাধিক শীর্ষ ১% উদ্ধৃত পেপারের উপর ভিত্তি করে প্রকৌশল বিভাগে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে পর পর ২ বার ড. এম এ হান্নানকে হাইলি সাইটেড গবেষক (এইচসিআর) যাহা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের ১,০০০ জনের মধ্যে ১ জন (০.০১%) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ড. এম এ হান্নান বর্তমানে মালয়েশিয়ার সানওয়ে ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে শক্তি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলে ডিস্টিংগুইসড অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তিনি এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার অ্যাপ্লিকেশনের ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক। এছাড়াও বর্তমানে তিনি স্কুল অফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কোরিয়া ইউনিভার্সিটির adjunct প্রফেসর এবং ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনাল মালয়েশিয়ার ভিজিটিং প্রফেসর। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ওলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ইলেকট্রিক্যাল, কম্পিউটার অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। সানওয়ে ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগে, প্রফেসর হান্নান মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল এনার্জি ইউনিভার্সিটি, কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন সিনিয়র অধ্যাপক এবং উদ্ভাবন ও গবেষণা ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র -এর গবেষণা ও প্রকাশনার উপদেষ্টা হিসেবে সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে মে ২০২৩ পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। ন্যাশনাল এনার্জি ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগে, ২০১৩ সাল থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিল্ট এনভায়রনমেন্ট অনুষদ, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার একজন পূর্ণ অধ্যাপক ছিলেন।
তার গবেষণার আগ্রহ পুনর্নবীকরণযোগ্য একীকরণ, এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম, হাইড্রোজেন স্টোরেজ, স্মার্ট গ্রিড, শক্তি এবং পাওয়ার অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেমের উপর। এনার্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, বিল্ডিং এনার্জি এফিসিয়েন্সি, ব্যাটারি কন্ট্রোলার এবং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, বৈদ্যুতিক যানবাহনের এনার্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ইনভার্টার কন্ট্রোলার, ফ্যাক্টস এবং কাস্টম পাওয়ার ডিভাইস, পাওয়ার কোয়ালিটি এবং ইন্টেলিজেন্ট এমবেডেড সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট একাডেমিক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক) পর্যায়ে গবেষণা ও উন্নয়ন। এই সব মৌলিক, ফলিত এবং প্রতিষ্ঠানিক গবেষণা এবং শিল্প বাণিজ্যিক গবেষণার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি প্রায় ৭৫ কোটি টাকা গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল পেয়েছেন।
এক বিবৃতিতে জানা যায়, ৬৯টি দেশের গবেষকরা এই স্বীকৃতি পান। তাদের মধ্যে একজন এম এ হান্নান। একজন বাংলাদেশী হিসেবে মালয়েশিয়াতে কেবল তিনিই এবারের স্বীকৃতি তালিকায় আছেন। বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, ২০১২ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১১ বছরে ড. এম এ হান্নানের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এম এ হান্নান ধারাবাহিকভাবে স্কুপাস ইনডেক্সে ১৬ হাজার ৩৯২ টি উদ্ধৃতিসহ ৪১৩ টি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। ড. এম এ হান্নানের ২৮ বছরেরও বেশি শিল্প, একাডেমিক শিক্ষা এবং গবেষণা কার্যক্রমে অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ ছাড়া, তিনি আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং সম্মেলনের কার্যক্রমে প্রকাশিত ৪৫০ টিরও বেশি নিবন্ধের লেখক বা সহ-লেখক।
ড.এম.এ হান্নান, মালয়েশিয়ায় ব্যাটারি শক্তি সঞ্চয় সমন্বিত গ্রিড গবেষণার অগ্রদূত। এছাড়াও, তিনি সাসটেইনেবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, মালয়েশিয়ার অধীনে ‘রিনিউয়েবল এনার্জি রিসার্চ রোডম্যাপ ফর মালয়েশিয়া, ২০৫০’ নীতি প্রণয়ন অধ্যয়ন দলের একজন অংশ ছিলেন এবং জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য শক্তি একীকরণের নীতি সুপারিশ ও অনুশীলনে অবদান রাখেন। তার গবেষণার প্রধান লক্ষ্য শক্তি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশল অ্যাপ্লিকেশনে মাল্টিডিসিপ্লিনারি, আন্তঃবিষয়ক এবং ট্রান্স-ডিসিপ্লিনারি গবেষণার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যাতে ভবিষ্যতের বৈদ্যুতিক শক্তি প্রয়োজনের জন্য দক্ষ, টেকসই এবং কম কার্বন প্রযুক্তি অর্জন করা যায়।
সানওয়ে ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক সিব্র্যান্ড পপেমা, অধ্যাপক এম এ হান্নানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “ক্লারিভেট হাইলি সাইটেড গবেষক (এইচসিআর) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া মহান কৃতিত্ব এবং সম্মানের ! অধ্যাপক এম এ হান্নানের এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সানওয়ে ইউনিভার্সিটি গর্বিত। ইউনিটেনের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নূর আজুয়ান আবু ওসমান বলেন, ‘এই সাফল্য ইউনিটেনকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার উৎকর্ষতায় বৈশ্বিক মঞ্চে এনেছে।’ অধ্যাপক ড. এম এ হান্নানের এ অর্জনের খবর মালয়েশিয়ার জাতীয় সংবাদ সংস্থা বার্নামাসহ শীর্ষস্থানীয় সবকয়টি সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করেছে। এ নিয়ে মালয়েশিয়ান ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
ড. এম এ হান্নান ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ এবং ইলেকট্রনিক প্রকৌশলে স্নাতক করেন। ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া (ইউকেএম) থেকে এমএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ড. এম এ হান্নানের গবেষণার আগ্রহের মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার বিকাশে ব্যবহারমূলক গবেষণায় দক্ষ ও টেকসই ব্যবস্থা অর্জন এবং ভবিষ্যতের জ্বালানির প্রয়োজনে কম কার্বন প্রযুক্তি অর্জন এবং শক্তি ও বিদ্যুৎ খাতে নেট-জিরো লক্ষ্য অর্জনে স্থিতি। এ ছাড়াও, উচ্চশিক্ষায় উপযুক্ত শেখার পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য একাডেমিক এবং শিল্প গবেষণা প্রযুক্তিকে শিক্ষণ ও শেখার প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করার সঙ্গে জড়িত ড. এম এ হান্নান।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বহলা গ্রামের মোহাম্মদ হোসেন ও হালিমা হোসেনের ছেলে ড. এম এ হান্নান। তার সহধর্মিণী ড. রওশন আরা বেগম পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন অর্থনীতিবিদ। তিনি মালয়েশিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানের কুমামোটো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ম্যাককুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন। একমাত্র মেয়ে নাহলা ইফতেশাম হান্নান সেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত।
অনুভূতি জানাতে গিয়ে ড. এম এ হান্নান বলেন, ‘একজন উচ্চ উদ্ধৃত গবেষকের স্বীকৃতি মহান সম্মানের। এটি অবশ্যই আমাকে ও আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও অনেক বেশি স্বীকৃতি দেবে, মনোবল বাড়াবে। আশা করি আমার দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশকেও গর্বিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার আকাঙ্ক্ষা হলো গবেষণা পরিচালনা, উচ্চমানের প্রশিক্ষণ এবং মিশনের নেতৃত্ব প্রদান, যার লক্ষ্য গবেষণার অখন্ডতা, শ্রেষ্ঠত্ব, এবং আর্থ-সামাজিক শক্তি পরিবর্তন, চ্যাম্পিয়নশিপ এবং বিশ্বব্যাপী অবস্থান অর্জনের দিকে প্রভাবের একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি রচিত করা।’ নতুন এবং উদীয়মান গবেষক-বিজ্ঞানীদের জন্য ড. এম এ হান্নানের উপদেশ, মানুষের মনের কৌতূহলই হলো সর্বোত্তম গবেষণার হাতিয়ার। তাই কৌতূহল এবং সহজাত প্রবৃত্তির উদ্রেককারী প্রশ্নগুলো অনুসরণের পরামর্শ থাকবে। এতে সাফল্য-স্বীকৃতি সবই ধরা দেবে। সেই সঙ্গে পরিশ্রম, সততা, সহযোগিতা এবং সহকর্মীদের প্রতি সম্মানের সঙ্গে আচরণেও সচেতন থাকতে হবে।