বিশ্বের অন্যতম নারী জলবায়ুবিজ্ঞানী : ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী

ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী। প্লাস্টিক দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে করেছেন একাধিক গবেষণা। ২০২৩ সালে জায়গা করে নেন এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায়। ওডব্লিউএসডির বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুবিষয়ক সেরা ছয় নারী বিজ্ঞানীর অন্যতম তিনি। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন; দেশের জন্য কাজ করবেন। এসব স্বপ্ন পূরণ করতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার মাস দেড়েক আগে এক দুর্ঘটনায় বাবা গুরুতর আহত হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। এর প্রভাব পড়ে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায়ও। পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের উৎসাহে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম দিনই সিদ্ধান্ত নেন, শিক্ষকতা ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন পূরণ করবেন তিনি।
ছেলেবেলার গল্প করতে গিয়ে ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রেখেছেন। যেমন সময় পেলেই তিনি আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে আসর বসাতেন, সেখানে আমরা কেউ কবিতা আবৃত্তি করতাম, কেউ গল্প বলতাম, কেউ আবার অভিনয়ের চর্চা করতাম। এছাড়া তিনি এলাকার শিশু-কিশোরদের নিয়ে “আমরা মুজিবসেনা” নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। আমরা সপ্তাহে তিন-চারদিন সংগঠনের শিশু-কিশোররা একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম; গান গাইতাম। এছাড়া একবার বন্যার সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা বন্যার্তদের কাছে আর্থিক সহযোগিতা পৌঁছে দিয়েছিলাম। এসব কাজে যুক্ত থাকার কারণে ছোটবেলা থেকেই মনে হতো, আমি এমন কিছু করব, যার মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারব, মানুষের জন্য কাজ করতে পারব। এ কারণে একসময় স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হব। কিন্তু যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন মনে হলো আমি একজন ভালো শিক্ষক হব। কারণ শিক্ষকতার মাধ্যমে সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা যায়।’
ঢাকার কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী। শিক্ষাজীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ছোটবেলা থেকেই পড়তে ভালো লাগত। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে আমার পুরো জগৎটাই ছিল লেখাপড়া নিয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে মেডিকেলে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার কিছুদিন আগেই আমার বাবা বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হন। যেহেতু আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ও আদর্শের মানুষটি আমার বাবা, এ কারণে এ দুর্ঘটনার জেরে মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়ি। পরবর্তী সময়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল হয়নি। সব মিলিয়ে এ সময়টায় কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ওই সময় কয়েকজন বন্ধু আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বলে। অনেকটা তাদের অনুরোধেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী। প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে দিনের বড় সময়ই ব্যয় করতেন বই পড়ে ও ল্যাবরেটরিতে। শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার পর তার গবেষণার পরিধি আরো বেড়ে যায়।
কমনওয়েলথ একাডেমিক স্টাফ স্কলারশিপের অধীনে ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি করেন ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী। গবেষণায় যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে এ অধ্যাপক বলেন, ‘ছোটবেলায় বইয়ে যখন বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কথা পড়তাম তখন মনে হতো আমিও যদি তাদের মতো হতে পারতাম, আমিও যদি তাদের মতো কিছু আবিষ্কার করতে পারতাম! এছাড়া মানুষের জন্য, দেশের জন্য কাজ করার একটি ইচ্ছে তো সবসময়ই ছিল। এসব বিষয়ই মূলত গবেষণায় আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।’
নারী হিসেবে অনেক চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হয়েছে গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরীকে। তিনি বলেন, ‘বেশকিছু জায়গায়ই এমন হয়েছে যে নারী হওয়ায় কোনো কাজের ক্ষেত্রে আমাকে “না” শুনতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যেত এভাবে বলা হতো যে তুমি এখনো জুনিয়র, এটা পারবে না, আরো সিনিয়র হও তারপর করো। অথচ সেই একই কাজ হয়তো আমার চেয়ে কম অভিজ্ঞ কোনো পুরুষ সদস্যকে করতে দেয়া হতো। তবে আমি কখনো থেমে যাইনি। যেখানেই “না” শুনেছি সেখানেই “না” শব্দটি “হ্যাঁ”তে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করেছি। কারণ আমি মনে করি, আমি যা করতে চাচ্ছি, তাতে কারো ক্ষতি নয়, বরং অনেকের উপকার হবে। তাহলে আমি কেন চেষ্টা করব না! আমার কোনো উদ্যোগের ফলে যদি একজনও উপকৃত হয়, তাহলে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আমার সেটি বাস্তবায়ন করা উচিত।’
সংসার ও কর্মজীবনের সমন্বয়ের মধ্যে কোন বিষয়কে কতটুকু অগ্রাধিকার দিতে হবে সেটি নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘একজন নারীর সামনে এগিয়ে যেতে পরিবারের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারকে পাশে পেলে সবকিছুই অনেক সহজ হয়ে যায়। এছাড়া নারীকে অবশ্যই তার নিজের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে এবং সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন বিষয়টি তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ কেউ একসঙ্গে অনেক কিছু করতে গিয়ে অনেক বেশি মানসিক চাপের মুখোমুখি হয় এবং কাজের ক্ষেত্রেও জটিলতা বাড়ে। এসব ক্ষেত্রে সে যদি অগ্রাধিকার বিবেচনায় বিষয়গুলো সমন্বয় করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে সফলতা অর্জন অনেক সহজ হবে।’ ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা মনে করেন, নারীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়লে এবং যারা বর্তমানে নারীবিজ্ঞানী বা গবেষক আছেন, তাদের যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা নিশ্চিত হলে বিজ্ঞানে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। এছাড়া যেসব নারী ভালো কাজ করছেন, তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। যখন সমাজের মানুষ দেখবে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নারীরা সম্মানের স্তরে পৌঁছাচ্ছেন, তখন আরো অনেকেই উৎসাহিত হবেন।