বাঙালি ছাড়াও বাংলা ভাষায় কথা বলে যারা
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সুবর্ণ ক্ষণ আজ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল বাঙালির শহীদ দিবস। একদিকে যেমন এই দিন আমাদের জয়ের প্রতীক, অপরদিকে স্মরণ করিয়ে দেয় ভাই হারানোর বেদনা। তবে স্বস্তি এইযে, বাঙালি সন্তানদের বুকের রক্ত বৃথা যায়নি। তাদের সম্মান আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের সাথেই গড়ে উঠেছে বাংলার ইতিহাস। কথা বলার ভাষা যে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার মর্মার্থ অনুধাবন করে আজকের দিনে বিশ্বের সকল মানুষ তাদের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। দিন দিন বাংলা ভাষার প্রচার বেড়েই চলেছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে অন্যান্য বিদেশী ভাষার সাথে, বাংলা নিয়েও পড়াশোনা করছে শিক্ষার্থীরা।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে শেখা প্রথম বুলি মুখে ফুটে ওঠে। প্রথম সেই স্মৃতির সাথে জড়িত কত আবেগ! কত ভালোবাসা! আধো আধো ভাষায় প্রথম কথা বলার যে স্মৃতি তা বড়ই আবেগের। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে কথোপকথনের মাধ্যমে। কথা বলতে বিভিন্ন দেশের মানুষ ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে। নিজের মায়ের থেকে আয়ত্ত্ব করা ভাষার মতো স্বাচ্ছন্দ্যে অন্য কোনো ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না।
বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই বাংলায় কথা বলে। তবে শুধুমাত্র আমাদের দেশেই বাংলায় কথা বলা হয় এমন নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেরও প্রধান ভাষা বাংলা। বাংলাদেশ সংলগ্ন অন্যান্য রাজ্যও বাংলা বা একই গোত্রীয় ভাষায় কথা বলে। শুধু তাই নয়; ত্রিপুরা, আসাম, আন্দামান- নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ, ঝাড়খন্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, উড়িষ্যার মতো রাজ্যগুলোতেও মানুষ বাংলায় কথা বলে। যেমন, আসাম রাজ্যের দক্ষিণাংশেও বাংলায় কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়। ভারতীয় কয়েকটি দ্বীপে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। এরমধ্যে অন্যতম আন্দামান এবং নিকোবার।
ওড়িয়া এবং অসমিয়া ভাষা সরাসরি বাংলা ভাষা না হলেও, এসব ভাষাকে ভোগিনী বা বোন বিবেচনা করা হয়। কারণ, এই সকল ভাষা একই উৎস, ইন্দো ইউরোপীয় থেকে এসেছে। সময়ের বিবর্তনে প্রথমে ওড়িয়া এবং পরে অসমিয়া বাংলা থেকে আলাদা হয়ে যায়। তবে এখনো এদের মধ্যে পর্যাপ্ত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
এইসকল ভাষাভাষির লোক অনায়াসে বাঙালিদের সাথে কথোপকথন করতে পারে। কোনো পক্ষেরই অন্য পক্ষের মন্তব্য বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয়না। এইজন্যই মানুষ বিশ্বাস করে, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এর ভাষা থেকে অন্যান্য ভাষার সূত্রপাত হয়েছে। অসমিয়া এবং ওড়িয়া ভাষা সাহিত্যের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় চর্যাপদকে।
তবে বাংলায় কথা বলা মানুষ শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সূত্রে বাঙালি ছড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বাংলা ভাষারও বিস্তার বেড়েছে। বিশ্ববাসী জেনেছে বাংলা ভাষা এবং এর ইতিহাস! অনেকেই এতে মুগ্ধ হয়ে আকৃষ্ট হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরহামেশাই দেখা যায়, অবাঙালিদের বাংলা দক্ষতা।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নিজের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে আজকের দিনে। তবে এশিয়ার বাইরেও একটি দেশে বিশেষ করে বাংলা ভাষার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধার নিদর্শন মেলে। অনেকেই হয়তো জানেন না, সূদূর পশ্চিম আফ্রিকার এক দেশের মানুষও বাংলাকে ভালাবাসে।
সিয়েরা লিওনে অনেক মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। দূরত্ব মাপতে গেলে অঙ্কের হিসাবে বাংলাদেশে থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের বাস। তবে সম্মানের সীমানা পরিমাপ করতে গেলে দেখা যায়, কোনো দূরত্বই দূরত্ব নয়। আফ্রিকার সুদূর দেশ সিয়েরা লিওন ভাষার দিক থেকে বাঙালির অনেক কাছের। একই ভাষায় কথা বলায় একে অপরের প্রতি ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়।
এর ইতিহাস বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ অবধি দরিদ্র এই দেশে গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাদের সেই করুণ সময়ে জাতিসংঘ থেকে শান্তিবাহিনী প্রেরণ করা হয়। তাদের মধ্যে সিংহভাগ ছিল বাঙালি। নিজেদের জীবন বাজি রেখে বাঙালি সৈন্যদের প্রাণপণ চেষ্টায় সামলে ওঠে সিয়েরা লিওন। একই সাথে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হয় সাধারণ জনগণ। সেই থেকেই তাদের মুখেও ফুটে ওঠে বাংলা বুলি। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে আপন করে নিয়েছেন এই দেশের জনগণ। ভাষা তাদের কণ্ঠে ফুটে ওঠে মধুর ধ্বনির,‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি?’