ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ ইলিশই উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। গত এক যুগে মাছটির উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে মাছটির উৎপাদন। কিন্তু এর পর থেকেই শ্লথ হয়ে এসেছে ইলিশ উৎপাদন। সর্বশেষ গত দুই অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশেরও নিচে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে আসার পেছনে নদ-নদী দখল, দূষণ, নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস এবং অপরিকল্পিত নৌ অবকাঠামোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইলিশ ডিম পাড়তে নদীর মোহনায় চলে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নদীতে দখল-দূষণ, ডুবোচর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মাছটির। ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে ইলিশের প্রজনন।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। এরপর এক দশক পেরোনোর আগেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মধ্যে উৎপাদন উন্নীত হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে। এ অনুযায়ী নয় অর্থবছরে দেশে মাছটির উৎপাদন বেড়েছে ৭৩ শতাংশের বেশি। এর পর থেকেই টানা কমছে উৎপাদন বৃদ্ধির গতি। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। অর্থাৎ পরের ছয় বছরে উৎপাদন বেড়েছে মোটে ১০ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বশেষ দুই অর্থবছর ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩-এ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে দশমিক ৩৫ ও দশমিক ৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নোনা জলের ইলিশ ডিম পাড়তে নদীর উজান ঠেলে মিঠা পানিতে উঠে আসে। ডিম ছেড়ে আবার ভাটিতে গা ভাসিয়ে দেয় সাগরের পথ। এর জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহের। বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবরে মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চলের পানি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং লবণাক্ততা থাকে না। আবার প্রবল স্রোত ও জোয়ার-ভাটার কারণে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। পাশাপাশি ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। বর্ষায় নদীর পানি তুলনামূলক উত্তাল থাকে বেশি। এ সময় পানিতে অক্সিজেনের মাত্রাও থাকে বেশি। এছাড়া মাছের বংশবিস্তারে পানির তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর ওপর নির্ভর করে মাছের ডিম ছাড়ার সময়। সামান্য তারতম্য হলেই মা-ইলিশ ডিম নষ্ট করে ফেলে। ইলিশের ডিম ফুটে বের হওয়া জাটকা পরিণত হতে শুরু করে নভেম্বরে। পুরোপুরি পরিণত ইলিশে রূপ নিতে সময় নেয় জুন পর্যন্ত। সাম্প্রতিক সময়ে নদীতে দখল-দূষণ, ডুবোচর ও অবকাঠামো নির্মাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীতে ইলিশের বিচরণসহ সার্বিক জীবনচক্রে ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে হুমকিতে পড়েছে ইলিশের প্রজনন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায়ও নদীতে ইলিশের বিচরণ হ্রাস ও এর অস্তিত্বের নানা হুমকির কথা বলা হয়েছে। এতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংকট, নদীতে অবকাঠামো নির্মাণ ও নদী দূষণ-দখলের প্রভাবের কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। অবকাঠামোর কারণে নদীর পানিতে পলি জমে সৃষ্টি হচ্ছে ডুবোচরের, বাড়ছে পানির অস্বচ্ছতা। এতে সমুদ্র থেকে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ইলিশের প্রজনন ও খাদ্যাভ্যাস হুমকির মুখে পড়ছে। সমুদ্রে পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে লবণাক্ততা এবং তা মিঠা পানিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, প্রজনন ও নার্সারি এলাকার পরিবর্তনের কারণেও হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে।