মতামত
জ্ঞানের তীর্থস্থান, গ্রন্থাগার বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিয়া
মিশরের ২য় বৃহত্তম শহর বন্দর নগরী আলেকজান্দ্রিয়া। রাজধানী কায়রো থেকে ২২০ কিলোমিটার উত্তরে ভূমধ্যসাগর তীরে অবস্থিত শহরটিতেই পৃথিবীর প্রাচীনতম লাইব্রেরি বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিয়া। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বাতলামিউসের শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়। গ্রন্থাগারটি তখন ‘আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগার বা আলেকজান্দ্রিয়ার রাজ-গ্রন্থাগার’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে সুবিস্তীর্ণ আয়তন নিয়ে গড়ে উঠা বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিটি ওপর থেকে স্তরে স্তরে নিচের দিকে ঢালু হওয়া এক অত্যাধুনিক প্রকৌশলের রূপায়ণ। বাইরে থেকেই এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দর্শকদের আকৃষ্ট করে। এর দেয়ালে খোদাই করা আছে বাংলা সহ বিশ্বের বিদ্যমান ও বিলুপ্ত প্রায় সব ভাষার বর্ণমালা।
খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্রস্থল মিশরের পতন শুরু হলে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অবনতি ঘটতে থাকে। খ্রিস্টপূব ৪র্থ শতকের শেষ দিকে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌত্তলিকতার প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। পুরোনো এবং নব্য খ্রিস্টানরা এটিকে নাস্তিকতা ও ব্যভিচারের কেন্দ্র বলে মনে করত। পৃথিবীর বিস্ময় এ লাইব্রেরিকে ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে বিশপ থিওকেলাস ধ্বংস করেন। তা ছাড়া ৪৭ অব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর জয় আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির পতনের অন্যতম কারণ। এভাবেই কালের বিবর্তনে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংস হয়। এ গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। যার ফলে বহু স্ক্রোল ও বই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। আলেকজান্দিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগারের অগ্নিকা- তাই সাংস্কৃতিক জ্ঞান ধ্বংসের প্রতীক।
এ অগ্নিকাণ্ডের সময় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কে এ অগ্নিসংযোগ করেছেন তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। একটি জনশ্রুতি হলো, বহু বছর ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে এ গ্রন্থাগার বিনষ্ট হয়। সম্ভবত ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের সময়, ২৭০ খ্রিস্টাব্দে আরেলিয়ান আক্রমণের সময়, ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে কপটিক পোপ থেওফিলাসের নির্দেশে এবং ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মিশরে মুসলমান আক্রমণের সময় সংঘটিত পৃথক পৃথক অগ্নিকা-ে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়।
পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ভূমধ্যসাগর তীরে যেখানে প্রাচীন গ্রন্থাগারটি এক সময় দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই পুরানো লাইব্রেরীটিকে পূর্ন জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া লাইব্রেরী কমপ্লেক্সটি ২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর উদ্বোধনের পর খুলে দেওয়া হয় দর্শকদের জন্য ।
বিশাল এ লাইব্রেরিটিতে আছে ৮০ লক্ষ বই রাখার মতো শেলফের ব্যবস্থা। মূল পাঠকক্ষটি প্রায় ৭০ হাজার বর্গ মিটারের যা ১১টির মতো চৌবাচ্চার ওপর অবস্থিত। মূল কমপ্লেক্সে একটি বিশাল কনফারেন্স সেন্টার, ৪টি মিউজিয়াম, ৪টি গ্যালারি। অস্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য একটি প্লানেটেরিয়াম, পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য আছে ল্যাব ।
মূল পাঠকক্ষের ওপর রয়েছে ৩২ মিটার দীর্ঘ কাচ দিয়ে ঘেরা ছাদ, দেয়াল তৈরি করা হয়েছে ধূসর বর্ণের আসওয়ান গ্রানাইট দিয়ে, যাতে ১২০ রকমের হস্তলিপি খোদাই করা আছে। লাইব্রেরিতে ইন্টারনেট আর্কাইভে পুস্তক, দলিলগুলোর অনুলিপি সংরক্ষিত আছে, প্রয়োজনবোধে সেখান থেকে এসপ্রেসো বুক মেশিনের সাহায্যে বই প্রিন্ট করে নেওয়া যায়।
ভূমধ্যসাগরের উপকূল ঘেঁষে একটি সুবিশাল ৬ তলা ভবনের ১ম তলায় দর্শন, ধর্মীয় বিষয়াবলি, ভূগোল, ইতিহাস, মানচিত্র, দুর্লভ গ্রন্থগুলো এবং এগুলোর সিডি প্রভৃতি রয়েছে। ২য় তলায় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত গ্রন্থগুলো, শ্রবণ ও দর্শনযোগ্য যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ। ৩য় তলায় শিল্পকলার ৭০০, সংগীতের ৭৮০ ধরনের এবং এতদসংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও গ্রন্থ। ৪র্থ তলায় পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার নিদর্শন, বিশ্বকোষ, সাধারণ জ্ঞান, গ্রন্থাগার বিজ্ঞান, ইউরোপ, মিশর প্রভৃতি সম্পর্কে লক্ষাধিক গ্রন্থ। ৫ম তলায় কনফারেন্স হল, মিটিং রুম, টলেমি গ্যালারি, ত্বহা হুসাইনের গ্রন্থাগার এবং মানববিদ্যা সম্পর্কিত হাজার হাজার বই। ষষ্ঠ তলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং গবেষণার জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক স্টাডি সম্পর্কিত শাখাগুলো রয়েছে। এ তলায় লাইব্রেরিয়ানদের কক্ষ রয়েছে। যেখান থেকে পুরা লাইব্রেরি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করা হয়। লাইব্রেরির অধিকাংশ গ্রন্থ আরবি, ইংরেজি, ফারসি, ফরাসি, ইতালি, জাপানি প্রভৃতি ভাষায়।
লাইব্রেরি চত্বরে অবস্থিত বিশাল গুম্বুজের জাদুঘর রয়েছে। যেখানে প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেন্ডার ছাড়াও বিশ্বশাসক বিশেষত সুলতান মাহমূদ গযনভী এবং সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেকসহ পৃথিবীর বিখ্যাত শাসকদের ছবি রয়েছে।