প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা, জাটকা নিধন বন্ধ, নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযানসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ২০০৪ সাল থেকে জাটকা নিধন রোধ ও ২০০৯ সাল থেকে মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শুরু হয়। এরপর থেকেই ইলিশের উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে বরিশাল বিভাগে। গত ১২ বছরে এ অঞ্চলে ইলিশ উৎপাদন ৪৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর। অবশ্য মৎস্য বিভাগের এমন তথ্য মানতে নারাজ জেলেরা। তাদের দাবি, দুই-তিন বছর আগে যে পরিমাণ ইলিশ মিলত তা এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদী ও সমুদ্র মিলিয়ে গত ১২ বছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৮ হাজার ২৩৯ টন।
বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বরিশাল বিভাগে ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬২ টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ৬১ হাজার ২৭২ টন ও সমুদ্রে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৯০ টন উৎপাদন হয়েছে। এরপর থেকে ধাপে ধাপে প্রতি বছর ইলিশ উৎপাদন বেড়েই চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ টন। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সালের মৎস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১২ বছরের ব্যবধানে ৪৬ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাগর মোহনায় ডুবোচরের কারণে নদীর নাব্য হারাচ্ছে। এতে স্রোতের তীব্রতা কমে যাওয়ায় ইলিশ প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই তুলনামূলক নদ-নদীতে ইলিশ কমছে। সাগরের এসব মোহনায় ডুবোচর খনন করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে পারলে ইলিশ প্রবেশ এবং প্রজননে বাধা থাকবে না।’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে মোট মাছের চাহিদার ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ পূরণ করছে ইলিশ। যার বাজার দাম ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে অবদানসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় ও আমিষ সরবরাহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ইলিশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার প্রধান উৎস্য এ মাছ। পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতিও এসেছে দেশে। দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ইলিশ জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) সনদ পায়। জিআই পণ্য হওয়ায় ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি এবং নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে সমাদৃত হবে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের নদ-নদীতে ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬১ হাজার ২৭২ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। একইভাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬৫ হাজার ৮৩৬, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৪ হাজার ৮৪০, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭১ হাজার ৭৬৭, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮৮ হাজার ২৫, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯১ হাজার ৪৯৮, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৪০, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪১, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৫ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৫ হাজার ২৯২ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে।
এছাড়া সমুদ্র এলাকায় ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ লাখ ৯ হাজার ৪৯০ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। একইভাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ লাখ ১০ হাজার ১৪১, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ লাখ ১২ হাজার ১৩৬, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩১, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৫ হাজার ১৫৬, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭২৭, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৭, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৭, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৭৮, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ লাখ ৪ হাজার ৯ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে নদী ও সমুদ্র মিলিয়ে উৎপাদন দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ টন। বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদী ও সমুদ্র মিলিয়ে গত ১২ বছরে মোট ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৮ হাজার ২৩৯ টন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ সামুদ্রিক মাছ হলেও ডিম ছাড়ার সময় নদীতে আসে। আবার সাগরে লবণের পরিমাণ বাড়লে বা পানি বেশি গরম হয়ে গেলেও ইলিশ নদীতে আসে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নদীতে এখন আর ইলিশ স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছে না। নদীতে ডুবোচর বেড়ে যাওয়া ও দূষণকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ইলিশের ধর্মই হচ্ছে সোজা পথে চলা। ডুবোচরে বাধা পেলে বিকল্প পথ না খুঁজে ফিরে যায় সাগরে।