ভ্রমণমতামত

“যা, জী লে আপনি জিন্দেগী”

যখন আপনার সামনে এতবড় দুনিয়া, তখন জীবনের সব সমস্যা মনে হবে তুচ্ছ

সংবাদ হাইলাইট
  • - শেষ বিকেলের ডায়রী
Shakil Hossain২০ কিংবা ৩০ বছরে ভবঘুরে হওয়াটা স্বাভাবিকই। কিন্তু সুর্য যখন মধ্যগগণ থেকে বিকেলের দিকে হেঁলে পড়েছে, তখন সবকিছুই শৃঙ্খলা নামক জেলখানায় বন্দি। যে বাস্তবতা অল্প বয়সে কল্পনাও করা যায় না, সেটাই মধ্যবয়সের স্বাভাবিক। সে যা হোক, ৮ দিনের ঈদের ছুটি পেলাম সেপ্টেম্বরের শেষে। ঘরের কাজ ও ভ্রমনসঙ্গীর অভাবে কোথাও যেতে পারছি না। বউ-বাচ্চার মোশন সিকনেস, গাড়িতে মাথা ঘোরায়। ঘরে বসে আফসোস করে করে ছুটি প্রায় শেষ। কোথাও যাওয়ার প্ল্যানিং করে সঙ্গীর অভাবে ভেস্তে যাচ্ছে। মনমরা চেহারা দেখে বউ ছুটির ৬ষ্ঠ দিন ২২ সেপ্টেম্বর রাত ৮ টায় অনেকটা ওইভাবেই বলে উঠলো, “যা, জী লে আপনি জিন্দেগী” 😜
আর পায় কে! ১ ঘন্টার মধ্যে ব্যাগে টুকটাক গুছিয়ে খেয়েদেয়ে ৯ টায় বেড়িয়ে পড়লাম একা “কোথায় যাবো জানিনা” এর উদ্দেশ্যে। প্রথমে সায়দাবাদ গিয়ে বাস কাউন্টারে লেখা গন্তব্য দেখে দেখে ভাবলাম কিছুক্ষন। বান্দরবানের সাইনবোর্ড দেখে মনে হলো মেঘ ছুঁয়ে আসি। টিকিট কেটে উঠে পড়লাম ১০টার এস আলমের বাসে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় যখন সেখানকার প্রেসক্লাবের সামনে নামলাম, ঘুমাচ্ছে ছোট্ট শহর বান্দরবান। বাসে কোনো টুরিস্ট ছিলো না। সব লোকাল তাই নেমেই যার যার বাসায়। একা একা অন্ধকারে হাঁটছি আর ভাবছি, কি করা যায়। সেখান থেকে আবার ফিরতি হাঁটা দিলাম নিরব পাহাড়ি উঁচু পথে, বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
গরীবের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নগিয়ে দেখি ৭ জনের তরুন যুবকের একটি দল, বয়স ১৮ থেকে ২২/২৩। কিছুটা অন্তর্মুখী টাইপের আমি, যোগাযোগে তেমন সড়গড় না। তারপরও তাদের সাথে কথা জমানোর চেস্টা করলাম শেয়ারে চান্দের গাড়ি ভাড়া করার জন্য। আমার যেচে পড়ে আলাপে দেখলাম, ৭ জন হয়েও তারা ঘাবড়ে গেছে। তাদের দুইজন আবার একসপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া মানুষ রান্নার কাহিনী স্মরন করছে কিছু দুরে! আসলে জায়গাটা খুব বেশী নিরাপদও না। কিছুদিন ধরে কুকিচিন সশস্ত্র গোষ্ঠির তৎপরতাও চলছে। আমি অভয় দিতে একজন কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠলো, “আপনি ৭ জনরে ঘুষায়াই মাইরালাইতে পারবেন!” 🙁
দেড় ঘন্টা টুকটাক আলাপচারিতায় বিস্তারিত পরিচয় বাড়তে থাকলো। ধীরে ধীরে খুলছে দুয়েকটা টং রেস্টুরেন্ট। আসছে একের পর এক ঢাকার টুরিস্ট বোঝাই গাড়ি। নাস্তা করলাম সবাই এক হোটেলে। সকালের আলো ফুটতে ফুটতে ৭ তরুনেরও সাহসের আলোও বাড়লো। পরে আরো ২ জন যোগ হলো। ৬৬০০ টাকায় গাড়িভাড়া করলাম ৫টি স্পটের জন্য। সব মিলিয়ে ১০ জন ছুটলাম নীলগিরির পথে। ২ ঘন্টায় অসাধারন সব পাহাড়ের বাঁক, দুর্দান্ত দৃশ্যপটে মুগ্ধ হতে হতে পৌছুলাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ট্যুরিস্ট স্পটে।
আহা, যারা গিয়েছেন, তারা তো জানেনই যে কিরকম সুন্দর জায়গাটা। অবর্ণনীয়! নীলগিরির চুড়ার একপাশে মেঘের ফাঁক গলে ক্ষনে ক্ষনে উঁকি দিচ্ছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা সাঙ্গু। নদীর চারপাশে ছড়ানো উঁচুনীচু শত পাহাড়। কোনটার চুড়ায় ছবির মতো সুন্দর বাড়ি থেকে সকালেই রান্নার ধোঁয়া উঠছে। দেখলে আপনারও ইচ্ছা জাগবে সেই কুঁড়েঘরের বাসিন্দা হতে। নীলগিরির দুইপাশে সামনের দিকটায় সাদা তুলোর মতো মেঘে ঢাকা। অপর পাশ মেঘমুক্ত, কারন নীলগিরি এতই উঁচু যে ওপারে মেঘ যেতে পারছে না। সাদা মেঘের পলকা ঝাপটা আর জবাফুলের ঝাড়ে অনেক প্রজাপতি আর পাখির হুটোপুটি দেখতে দেখতে প্রায় দুপুর।
সেই ৭ বান্দার ৬ জন।অনিচ্ছায় উচু থেকে নীচুর দিকে আবার ফিরতি পথে গাড়িতে উঠলাম। গন্তব্য চিম্বুক ভিউ পয়েন্ট। পথের পুরোটাই মাথা খারাপ করার মতো সুন্দর আর নিস্তব্ধ। নানা জায়গায় থেমে থেমে চোখে মুগ্ধতা নিয়ে, মগজে আর মোবাইলে স্থায়ী ছাপ বসানোর চেস্টা কারো।
চিম্বুকের জেলা প্রশাসনের ভিউ পয়েন্ট আরেক রকম। অনেকটা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সবুজ মিনিয়েচার ভার্সন যেন। সেখানে কিছুক্ষন থেকে আবার শৈলপ্রপাতের ঝর্নার পথে। সেটা তেমন ভালো না লাগাতে, শহরের দিকে ছুটলাম খাবারের খোঁজে। বাঙ্গালী খাবার হোটেলে অতিরিক্ত দামে জঘন্য খাবার খেয়ে ৩ টায় ছুটলাম মেঘলা পর্যটন স্পটে। গিয়ে বিরক্ত, তেমন আহামরি কিছু না জায়গাটা। শুধুই প্রকৃতি নস্ট করে স্থাপনা বানানোর সরকারী অপচেস্টা মনে হলো।
এরপরের গন্তব্য নীলাচল। নীলগিরির মাঝারি ভার্সন। এটাও অনেক সুন্দর। শহরের কাছাকাছি হওয়াতে ফ্যামিলি ট্যুরের জন্য ভালো অপশন। বিকেল ঢলে বিষন্ন সন্ধ্যা নামলো পাহাড়ে। ফিরলাম শহরে। সেই তরুনের দল কক্সবাজার যাবে। আমাকেও অনুরোধ করলো ওদের সঙ্গী হতে। ঘরের টানে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে ফেরার গাড়ি ধরলাম। সরাসরি বাস নেই, তাই লোকালে ভেঙ্গেচুরে চট্টগ্রাম এলাম। ৯.২০ এর গাড়ি ধরলাম ঢাকার।
রাত ৩ টায় সায়দাবাদ হুজুরবাড়ির সামনে বাস নামালো। দরাদরি করে এক বাইক নিয়ে রাত ৩.১০ এ পৌছে গেলাম নিজ ঠিকানায়।
কাঁটায় কাঁটায় ৩০ ঘন্টার হটাৎ ভ্রমনে গাড়িতেই ছিলাম বোধহয় ২১/২২ ঘন্টা। পথের ক্লান্তি মুছিয়ে দিয়েছিলো সাদা মেঘের দল। এজন্যই বলে, ভ্রমন অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন মানুষের জীবনে।
পুনশ্চ:
২০০৫ এর আগেই বাংলাদেশের বেশীর ভাগ জেলা ভেজে খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের বন্ধুদের। সে সময় টুরিস্ট, ট্রাভেলার, ব্যাকপ্যাকার, এসব শব্দ পরিচিত ছিলো না দেশে। খুব কম মানুষই ঘুরতে যেত। প্যান্ডেল টানানো বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া ছাড়া ঘোরার প্রচলনই ছিলো না তেমন। যখন দেশে ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা ও নানা সুযোগ বাড়ছিলো, ততদিনে আমাদের ঘোরার সঙ্গীরা বিয়ে করে মোটামুটি শহীদ!

এমন আরো সংবাদ

Back to top button