নড়াইলে ছাদ বাগান মালিকদের মডেল তনিমা আফরিন
নড়াইল জেলার ছাদ বাগান মালিকদের মডেল তনিমা আফরিন। শখের বসে ছাদ বাগান করলেও এখন বাগান থেকে পরিবারের ফল-সবজির চাহিদা মেটাচ্ছে। পাশাপাশি গাছের চারা বিক্রি করে বছরে আয় করছেন লক্ষাধিক টাকা। জানাগেছে, স্কুলজীবনে বিয়ে করা তনিমা আফরিনের (৪২) এইচএসসি পাস করে কলেজে ভর্তির পর আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। সাংসারিক জীবনে অধিকাংশ সময়ই কেটেছে স্বামীর কর্মস্থলে। স্বামী নাজমুল হক সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বছর তিনেক পূর্বে অবসরে গেছেন। স্বামীর বিভিন্ন জায়গার কর্মস্থলে তনিমা গড়ে তুলেছিলেন বেলকোনি বাগান। বর্তমানে নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন বিশাল আকৃতির ছাদ বাগান।
নড়াইলের সব থেকে ভালো মানের ছাদ বাগানের মালিক এ গৃহিনী। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এ শখের বাগান থেকে প্রতিবছর ইনকাম করছেন লক্ষাধিক টাকা।‘শখ থেকেই মূলত সেই বাগান করা শুরু। সেখান থেকে নেশা। আর এখন পেশা। বাগান থেকে আয় করতে হবে, পুরস্কার পেতে হবে এ চিন্তা কখনওই মাথায় ছিল না। অথচ অল্প সময়ে মিলেছে জাতীয় পুরস্কার।’ এ বাগান মালিক তনিমাকে দেখে নড়াইল শহরে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অন্তত শতাধিক ছাদ বাগান। তনিমা ইতোমধ্যে নড়াইলের ছাদ বাগান মালিকদের মডেল হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
শহরের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের খেলার মাঠের দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশে চারতলা ভবন। এ বাড়িটি তনিমা আফরিনের। তিনতলায় স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকেন জাতীয় কৃষি পুরস্কার পাওয়া এ বাগান মালিক তনিমা। এ বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন ছাদ বাগান। গত বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন তনিমা আফরিন। কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ওই দিন ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন কৃষি মন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ পুরস্কার বিতরণীতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সূত্র জানায়, বাগান মালিক তনিমার মা তহমিনা হুসাইন ছিলেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। শিশুকাল থেকে মাকে দেখেছেন নানা ফল ও ফুলের গাছ লাগিয়েছেন বাড়িতে। অফিস থেকে এসে পরিচর্যা করতেন। ওই সময় তার (তনিমার মা) কাছে অনেকে এসেছেন আবাদের পরামর্শ নিতে। এ পরিবেশে বড় হয়ে ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তার। নড়াইল শহরে বাড়ি করার পর ২০১৬ সালে নিজ বাড়িতে চলে আসেন তনিমা। স্বামীর কর্মস্থল থেকে বাড়িতে আসার সময়ে ৩৮টি টবে করে গাছ নিয়ে এসেছিলেন। সেই টব দিয়ে তখন থেকে শুরু করেন ছাদে বাগান করা। অল্প অল্প করে গড়ে তুলেছেন বিশাল আকৃতির এ বাগান।
বাগান সমৃদ্ধ করতে দেশের নামকরা নার্সারিগুলোতে গিয়েছেন তনিমা। গিয়েছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছাদবাগান দেখতে। সেখান থেকে ট্রেনে করে, বাসে করে অনেক কষ্টে জোগাড় করা ওই ছাদবাগানের চারাগুলো। বর্তমানে ছাদবাগান সংক্রান্ত চারটি ফেসবুক গ্রুপ চালান তনিমা। যুক্ত আছেন এ সংক্রান্ত অর্ধ শতাধিক ফেসবুক গ্রুপে। এর মাধ্যমে চারা সংগ্রহ করেন, পরিচর্যা শেখেন, অন্যদের পরামর্শ দেন। বিভিন্ন জেলায় চারা বাজারজাতকরণও তাঁর ফেসবুকের মাধ্যমেই। ফেসবুকে তাঁর শুধু গাছের সঙ্গে মিতালী। ধ্যান-জ্ঞানে সর্বক্ষণ তাঁর গাছ আর গাছ। সমৃদ্ধ ওই ছাদ বাগান থেকে তিনি চারা বিক্রি করেন। তাঁর এখান থেকে কিনে নেওয়া চারা থেকে অনেকেই গড়ে তুলেছেন ছাদবাগান। নিজে গিয়ে পরামর্শ দেন ছাদবাগান পরিচর্যার। এভাবে তাঁর অনুপ্রেরণায় নড়াইল শহরের অনেক বাড়িতে বাগান গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে তনিমা আফরিনের ছাদ বাগানে যেয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের গাছগুলো প্রজাতি অনুযায়ী সারি সারি সাজানো। লোহার পাত দিয়ে র্যাক তৈরি করে, তার ওপর রাখা অধিকাংশ টব। সরাসরি ছাদের ওপরও রাখা আছে অনেক টব। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে পাকা করে করা হয়েছে হাউজ। সেখানে মাটি দিয়ে লাগানো হয়েছে গাছ। প্রতিটি সারির মাঝে আছে গলিপথ। গলিপথ ও গাছগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নেই কোনো ময়লা-আবর্জনা। এমনভাবে গাছগুলো সাজানো, সব গাছে পড়ছে রোদ। প্রতিটি গাছের পাশে যাচ্ছে দাঁড়ানো। সবুজের সমারোহ আলতো বাতাসে দোলা খাচ্ছে, সে এক অন্যরকম নয়নাভিরাম দৃশ্য।
দেশের নানা জায়গা থেকে জোগাড় করেছেন হরেকরকম ফুলগাছ। তাঁর ছাদে গোলাপই আছে ৪৫ প্রকার। ২০ প্রকার জবা ফুল, ৮ প্রকার কাঁটগোলাপ, ৫ প্রকার শাপলা, ১০ প্রকার রেইন লিলি। আছে ২৫ প্রকার অর্কিড। এ ছাড়া সারি সারি শোভা পাচ্ছে অ্যাডেনিয়াম, রঙন, বেলি, মাধবীলতা, পানচাটিয়া, হাসনা হেনা, নন্দিনী, মালঞ্চ, পদ্ম, কাঁটামুকুট, জার্বেরা, রজনীগন্ধা, গাদা, চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়া, গজানিয়া, পেঞ্জি, ক্যালুন্ডেলা, ভারবেরা ও স্কটসহ আরও দেশি-বিদেশী হরেক প্রজাতির নানা ফুলগাছ।