আগে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশা শুধু দিনে কামড়াত, এখন রাতে কামড়ানোর চিত্রও দেখা যাচ্ছে। এ মশা আগে ডিম পাড়ত স্বচ্ছ পানিতে, এখন ডিম পাড়ছে ময়লা পানিতেও। এতটাই বদলে গেছে এডিস মশার আচরণ আর তাতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শঙ্কা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ভয়ংকর হয়ে উঠছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানামুখী চাপে আচরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছে এডিস মশা। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কীটনাশকনির্ভর মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আচরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছে এ মশা। যদিও সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে ডেঙ্গু তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শুধু কীটনাশক প্রয়োগের কারণেই।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। তখন থেকেই প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অল্পবিস্তর ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হতে থাকে। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন থেকে ঢাকাবাসীর জন্য একটি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে ডেঙ্গু। চলতি বছরও সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহক এডিস মশা অল্প অল্প করে তার আচরণ বদলাচ্ছে। তাতেই নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা।
এডিস মশার আচরণ পরিবর্তনের বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, আগে এ মশাটি শুধু দিনে কামড়াত। সম্প্রতি কয়েক বছরে দেখা গেছে মশাটি রাতেও কামড়াতে পারে। আগে এ মশা শুধু স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ত। এখন এটি ময়লা পানিতেও ডিম পাড়ছে। এডিস মশার আচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে ডেঙ্গুর লক্ষণেও। চিকিৎসকরা বলছেন, আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসত। কিন্তু এখন জ্বর কম থাকলেও শক বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও।
ঠিক কী কী কারণে এডিস মশা তার আচরণ বদলেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘নানামুখী চাপে এডিস মশা তার আচরণ বদলাতে বাধ্য হয়েছে। মূলত মশাটি বাঁচার তাগিদেই তার কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে কীটনাশক বড় ভূমিকা পালন করেছে। সম্পর্ক আছে অপরিকল্পিত নগরায়ণেরও। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের ওপর বেশি নির্ভর করছে। আমরা বহু আগে থেকেই বলে আসছি শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য পুরো বছর পরিকল্পিত কাজ করতে হবে। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প পথ নেই।’
কীটনাশকনির্ভর মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ডেঙ্গুর আচরণ বদলাতে বড় ভূমিকা রাখছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বরাদ্দের প্রায় শতভাগই ব্যয় হয় কীটনাশকের পেছনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মশা নিয়ন্ত্রণে ২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে ২৫ কোটি টাকা কীটনাশক ক্রয়ে এবং বাকি টাকা ফগার স্প্রে মেশিন পরিবহনে ব্যয়ের খাতে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ গত অর্থবছরে বরাদ্দের শতভাগ টাকাই কীটনাশক ক্রয় ও ছিটানোতে ব্যয় করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। একই বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৪০ কোটি টাকার কীটনাশক ক্রয় করা হবে এবং আরো ২৯ কোটি টাকা স্প্রে ম্যান ও ফগার মেশিন পরিবহনে ব্যয় করা হবে। অর্থাৎ ৬৯ কোটি টাকাই কীটনাশকের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ডিএনসিসি।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মশক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে ডিএসসিসি। যার পুরো টাকাই কীটনাশক ক্রয় ও ছিটানোর পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। একই বছর ডিএনসিসি মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ দিয়েছে ৮৫ কোটি টাকা এবং কীটনাশকের পেছনে ব্যয় করেছে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। কীটনাশক ছাড়াও অপরিকল্পিত নগরায়ণ মশার আচরণ বদলাতে ভূমিকা রাখছে বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘যেসব জায়গায় এডিস মশা জন্মায় নগরায়ণের কারণে ওইসব জায়গায় যখন পরিবর্তন আসে, তখন এডিস সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। বিশেষ করে রাতে যখন বাসাবাড়িতে উজ্জ্বল আলো জ্বলে তখন মশা দিনের মতোই কামড়াতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্বচ্ছ পানির জলাধার কমে গেলে মশা বাঁচার তাগিদেই নোংরা পানিতে ডিম পাড়তে অভ্যস্ত হয়ে যায়।’
মশার আচরণ পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীর উপসর্গেও পরিবর্তন এসেছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অতিমাত্রায় কীটনাশক ছিটানো হলে মশার দেহে এটা সহনশীল হয়ে যায়। ফলে একটা সময় আর কীটনাশকে মশা মরে না। শুধু মশা নয়, সব ভাইরাসই অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলে নিজেকে ওই ওষুধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখে যায়। ফলে আমরা দেখছি ডেঙ্গু রোগীরও উপসর্গ বদলে গেছে। আগে ডেঙ্গুতে এত মানুষ মারা যেত না। এখন কিন্তু মৃত্যুর হার বাড়ছে। আগে রোগীর প্রচণ্ড জ্বর হতো। ১০৩-৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর উঠত। এখন দেখা যায় ১০০-১০১ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে রোগী আসছেন। এখন রোগীদের পেটে ব্যথা হয়। আগে এমনটা দেখিনি। অল্পতেই রোগী শকে চলে যায় এবং মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এগুলো সবই মশা ও ভাইরাসের আচরণ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘ডিএসসিসি সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেই কীটনাশক প্রয়োগ করে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়।’ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত নন বলেও মন্তব্য করেন।