জলবায়ুর অভিঘাতের ঝুঁকিতে চরাঞ্চলের দেড় কোটি মানুষ
নদীভাঙনে মনের ভেতর কান্না থাকে বছরজুড়ে
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কখন, কোন ধরনের দুর্যোগ চরবাসীর জীবন এলোমেলো করে দেয় বলা মুশকিল। বন্যা, শিলাবৃষ্টি, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় হানা দেয় চর এলাকায়। ছোটবেলা থেকে বছরের একটি সময়ে বন্যা দেখে আসা মানুষ এখন বন্যার সময় ঠাহর করতে পারেন না। যে শিলাবৃষ্টি শিশুদের খেলার উপকরণ ছিল, সেটাই এখন প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। চরবাসী বলছেন, দুর্যোগে তাঁদের চোখের কান্না দেখে সরকার এগিয়ে আসে, সামান্য সাহায্যও করে। কিন্তু সারা বছর হৃদয়ে যে দুঃখ থেকে যায়, সে খবর কেউ রাখে না। চর এলাকায় জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্র এবং সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম গাইবান্ধা সদরের কুন্দেরপাড়া চরে জলবায়ুবিষয়ক গণশুনানির আয়োজন করে ২১ মার্চ। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের চরটিতে এ গণশুনানিতে তিন জেলার ১৩ জন তাঁদের জীবনে দুর্যোগের প্রভাবের কথা তুলে ধরেন। চরবাসীর কথা শুনতে এমন আয়োজন বাংলাদেশে প্রথম বলে দাবি করেন আয়োজকরা।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের বাদশা মিয়ার বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। এরই মধ্যে সাতবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে তাঁর পরিবার। কত জায়গায় কত কাজের সন্ধান করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এরই মধ্যে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় দুই পায়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন। হুইলচেয়ারে বসে বাদশা মিয়া বলেন, আপনারা বিপদের সময় ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসেন, কিন্তু সারা বছর আমরা কী করি তা দেখেন না। নদীভাঙনের কারণে বছরজুড়ে মনের ভেতর কান্না থাকে, এটা কেউ বোঝে না।
একই ইউনিয়নের জয়গুন বেগম বলেন, নদীভাঙন এলাকার নারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন। এই দুঃখ নারী ছাড়া কেউ বোঝে না। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা আসে, বয়ঃসন্ধিকালে সমস্যা হয়, বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। আর প্রতিবন্ধী হলে তো কথাই নেই। আবার একটু বয়স হতে না হতেই পুষ্টিহীনতার কারণে বেশি বয়সী দেখা যায়। বিয়ের পর গর্ভাবস্থায় চরাঞ্চলে কী ধরনের সমস্যায় ভুগতে হয়, সেটা বাইরের কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুনি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ করেই বন্যা হয়ে যাচ্ছে, নদী ভেঙে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী ধনী দেশ। তাহলে আপনারা (সরকার) ওই সব দেশকে কেন বলেন না, ওদের কারণে আমাদের ভোগান্তি বাড়ছে।’
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগে শিলাবৃষ্টি হলে শিশুরা ছোট ছোট শিলা নিয়ে খেলত, এখন বড় আকারের শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হচ্ছে, মাঠে থাকা পশুপাখি, মানুষ মারা যাচ্ছে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার লাকী বেগম ২০১৯ সালে টানা দুই সপ্তাহের বন্যায় ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই সময় লাকীর স্বামী কাজের সন্ধানে শহরে ছিলেন। অপ্রত্যাশিত বন্যায় ভেবেছিলেন চৌকির ওপর বসে থেকে রাত কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু মধ্যরাতে বন্যা অস্বাভাবিক রূপ নেয়। নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধ মা এবং সন্তানদের রেখে পাশের বাড়িতে সাহায্য চাইতে যাওয়ার সময় নিজেই পানির তোড়ে ভেসে যেতে বসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই রাতে আমার মনের অবস্থা কী ছিল, এটি কীভাবে বুঝাবো, আপনারা সেইটা বুঝবেন না, যারা বিপদে পড়ে তারা বোঝে।’
একই উপজেলার সালেহা বেগম বলেন, ‘আমার পরিবারের পেশা মাছ ধরা। বন্যার পানি বেশি আসলে মাছ পাওয়া যায় না, পানি শুকিয়ে গেলেও মাছ পাওয়া যায় না। প্রতিবন্ধী স্বামী, বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে কীভাবে চলি, বড় বন্যার সময় কী করি, বলে বুঝাতে পারবো না।’ এ সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান প্রশ্ন করেন, বাড়িতে নৌকা রাখেন না? বন্যা হলে প্রশাসন থেকে সাহায্য যায় না? জবাবে সালেহা বলেন, জীবনই তো চলে না, কোনোমতে পেটটা চালাই, নৌকা বানাবো কীভাবে? আর বন্যার পানি তো কাউকে বলে আসে না। সরকারি সাহায্য আসার জন্য বসে থাকা যায় না। এ ছাড়াও গণশুনানিতে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন কুড়িগ্রামের সুরুজ্জামান, মনোয়ারা বেগম, গাইবান্ধার এনামুল হক, হামিদা বেগম, শাহিনা বেগম, মতিউর রহমান, লালমনিরহাটের রেশমী আক্তার প্রমুখ।
গণশুনানিতে প্রধান বিচারক হিসেবে ছিলেন জলবায়ুবিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত। সহবিচারক ছিলেন সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি ভারতীয় সাংবাদিক আশীষ গুপ্ত ও উন্নয়নকর্মী অধ্যাপক জহিরুল কাইয়ুম। ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে দেশের চরাঞ্চলের দেড় কোটিরও বেশি মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল দায় উন্নত বিশ্বের। তাদের কাছে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কথা তুলে ধরে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে, সেই সঙ্গে পরিবেশদূষণ কমাতে পশ্চিমা দেশগুলোকে রাজি করাতে হবে। এতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, গাইবান্ধার ডিসি অলিউর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও ছিলেন গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম আবদুস সালাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের নির্বাহী সভাপতি কেরামত উল্লাহ বিপ্লব।