দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর থাকছে রাজধানীর বাতাস। মাঝেমধ্যে সারা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে আসছে। গত ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর বায়ুমান সূচক ছিল ৪০৪.০৮, অথচ ৩০০-এর বেশি হলে তা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ মাত্রার চেয়েও বেশি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত। সূচক ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে হলে তা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। অনেক জেলা শহরেও দূষণ ঝুঁকির পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনকি কখনও কখনও ঢাকাকে ছাড়িয়ে গেছে রংপুর-সিলেটের মতো কিছু শহর। তবু সরকার এ বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করছে না; বরং দূষণের মাত্রা কমিয়ে দেখাচ্ছে। বায়ুদূষণে অ্যাজমা, নিউমোনিয়ার মতো রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
তা ছাড়া গর্ভপাত, জন্মত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশেও বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বায়ুদূষণ। ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। ঢাকার শ্যামলীর টিবি হাসপাতালে গত নভেম্বরে ৯ হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, যা গত বছরের চেয়ে বেশি। অন্তত দুই যুগ আগে ঢাকার বায়ুদূষণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আলোচনায় আসে।
সরকার ব্যাপক তোড়জোড় করে ঢাকার ডিজেলচালিত যানগুলো সিএনজিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয় বায়ুদূষণ কমানোর জন্য। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ করা হয় ক্ষতিকর ধোঁয়া থেকে পরিবেশ রক্ষার জন্য। তারও আগে থেকে মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩ আইন হয়।
এসব বিধি অনুযায়ী কালো ধোঁয়া নির্গত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবু ভিড়ের মধ্যে কালো ধোঁয়া ছেড়ে দাপিয়ে বেড়ায় গাড়ি। শহরজুড়ে ছোটখাটো কারখানা আর শহরের পাশের ইটের ভাঁটাও চলছে। তা ছাড়া বিভিন্ন খোলা জায়গায় এবং রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী রাখায় ধুলো ছড়ায়, যা বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ।
ক্ষতির মাত্রা
বায়ুমান সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ৫০-এর মধ্যে থাকলে সেই বাতাসকে বলা হয় ভালো। ১০০ পর্যন্ত সহনীয়। ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ উল্লেখ করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোর ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। আর ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত।
বাংলাদেশের একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র (ক্যাপস) বলছে, ২০২২ সালের কোনো মাসেই বায়ুর মান ১০১ একিউআইয়ের নিচে ছিল না; গড় বায়ুমান ছিল ১৫৪.৯৭ একিউআই, অর্থাৎ ‘অস্বাস্থ্যকর’। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে বায়ুর গড় স্কোর ছিল ১৯৪.৮৩ থেকে ২২১ একিউআইয়ের মধ্যে, অর্থাৎ মানুষের সহনশীল মাত্রার চেয়ে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। ২০২২ সালে বর্ষাকালে বায়ুর মান ছিল ১০৫ একিউআইয়ের ওপরে, অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর ছিল। অন্যদিকে ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল যথাক্রমে ১৭৬.২৩ ও ২৪৪.৪৪ একিউআই এবং চলতি জানুয়ারি মাসে দুই দিন ছিল ৩১৭.৪৪ ও ৩০২.৫৪ একিউআই এবং এক দিন ৪০৪.৪৪ একিউআই হয়, যা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। আর এ মাসের ১৭ দিনের বায়ুর মান ছিল ২০০ ওপরে।
কী ক্ষতি হয়
বায়ুদূষণে যেসব ক্ষতি হয়, কী পরিমাণ ক্ষতি হয় এবং কীভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে সে সম্পর্কে জানিয়েছেন শ্যামলীর টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, গত নভেম্বর, ডিসেম্বর ও চলতি মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি রোগী সেবা নিয়েছেন বায়ুদূষণজনিত কারণে। মূলত শীত মৌসুমে ধুলাবালি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিওপিডি, অ্যাজমা, কাশি, নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু ও বৃদ্ধ। শিশু ও বৃদ্ধদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকায় বায়ুদূষণের কারণে ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
গবেষকরা বলছেন, রাসায়নিক বিভিন্ন দূষণের কারণে অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াল বায়ুদূষণ বাড়ছে রাজধানীতে। এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, যা উন্মুক্তভাবে বর্জ্য ফেলে রাখার কারণে ছড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালির সঙ্গে মানুষের গলায় ঢুকে ইনফেকশন তৈরি করছে। এ কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, বলছেন গবেষকরা। একই সঙ্গে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ। শ্যামলীর টিবি হাসপাতালের রোগীর তালিকায় দেখা যাচ্ছে, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সিওপিডি ও অ্যাজমার মোট রোগী ছিলেন যথাক্রমে ১১৭ ও ১০০ জন। নভেম্বরে ৩৭৬ ও ৩১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন নভেম্বরে ৯ হাজার ২৮৮ জন, ডিসেম্বরে ৮ হাজার ৪৬২ জন।
গড়ে ৭ বছর করে আয়ু হারাচ্ছে
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) গবেষণায় বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণকারী দেশ উল্লেখ করে বলা হয়। দূষণের কারণে বাংলাদেশিরা গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। বায়ুদূষণ জীবনকাল সূচক অনুযায়ী, সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে আট বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন। চট্টগ্রামে আয়ু কমছে সাড়ে ছয় বছর করে। অন্যান্য শহরে এর চেয়ে একটু কম।
মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশনা
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে গত আট বছরে উচ্চ আদালত ১১টি নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। নির্দেশনাগুলো মানা হলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যখন নির্দেশনা মানা হচ্ছে না তখন বোঝা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর আগ্রহ ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান।
নেই সতর্কবার্তার উদ্যোগ
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মাঝে মাঝেই নাগরিকদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়, যাতে তারা সচেতন থেকে ক্ষতি কিছুটা এড়িয়ে চলতে পারেন। এমনকি সেখানে স্কুল বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ২ নভেম্বর সে দেশের সরকার কয়েক দিনের জন্য স্কুল বন্ধ রাখে। দিল্লির বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাস্কও দেওয়া হয়। তা ছাড়া কয়েক দিনের জন্য আউটডোর গেম থেকে বিরত থাকারও পরামর্শ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশ সরকার এখনও সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সরকার দূষণের মাত্রা কমিয়ে দেখাচ্ছে
২০২১ সালে জাতীয় বায়ুমানমাত্রা নির্ধারণ করা হয় বছরে গড়ে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এর বেশি হলে তা দূষণ। সেই অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে ধুলাবালির মধ্যে পিএম২.৫ পাওয়া যেত ৭৫-৮০ মাইক্রোগ্রাম, যা মানমাত্রার থেকে পাঁচগুণ বেশি। ২০২২ সালের নতুন বিধিমালায় মানমাত্রা করা হয়েছে ৩০ মাইক্রোগ্রাম। এ হিসাবে এখন মাত্র দুই-আড়াইগুণ বেশি দূষণ দেখানো হচ্ছে।
ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থাপনা না নিয়ে বায়ুদূষণের যে মানমাত্রা রয়েছে, তা হালকা করে দূষণের মাত্রা কম দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের এমন পদক্ষেপ বিপজ্জনক।
বায়ুদূষণের প্রধান কারণ
বিভিন্ন খোলা জায়গায় এবং রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী রাখায় ধুলো ছড়ায়। তা ছাড়া উন্মুক্তভাবে নির্মাণকাজের সময়ও ধুলো ছড়ায়। কালো ধোঁয়া আর ধুলো ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে সমালোচনা হলেও যারা পদক্ষেপ নেবেন তাদের সক্রিয় দেখা যায় না। বাংলাদেশ সরকার বরং দূষণের মাত্রা কমিয়ে দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাঁটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলো।
ঢাকার ১৬ লাখ গাড়ির মধ্যে ৫ লাখেই দূষণ
ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক কামরুজ্জামান গবেষণার তথ্য দিয়ে জানাচ্ছেন, ঢাকায় চলাচল করা ১৬ লাখ গাড়ির এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ পাঁচ লাখের বেশি গাড়ি দূষণের জন্য দায়ী। জীর্ণশীর্ণ গাড়িগুলো চলতে দেওয়ায় শহরে দূষণ বাড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা সুস্পষ্টভাবে বায়ুদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কোন উৎস থেকে কতটুকু দূষণ হচ্ছে তা-ও জানা আছে তাদের। উৎসগুলো থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে টেকসই ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারায় দূষণ নির্মূল হচ্ছে না।
শহরজুড়ে ১০০ স্পটে পোড়ানো বর্জ্য থেকে দূষণ
মাতুয়াইল, আমিনবাজার ময়লার ভাগাড়সহ ঢাকার অন্তত ১০০ স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয়। অধ্যাপক কামরুজ্জামান মনে করেন এ কারণে বায়ুমানসূচকের শীর্ষে উঠে আসছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, শীত মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণ এ সময় ইট ও বর্জ্য পোড়ানো হয়।
পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে আসছে দূষিত বাতাস
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে দূষিত বায়ু বাংলাদেশে আসে। এতেও বাংলাদেশের বায়ু দূষিত হয়। তা যাতে না হয় সেজন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং প্রচলিত ইটভাঁটা কমিয়ে ব্লকের উৎপাদনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানান মো. জিয়াউল হক।
অন্যান্য শহরে দূষণ
শুধু ঢাকায় না, অন্যান্য বড় সব শহরের বাতাসও ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে দিন দিন। আগে সুরক্ষা নিশ্চিত না করে উন্নয়নকাজ চালাতে গিয়ে ডেকে আনা হচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি। যেমন সিলেট। চলতি শুকনো মৌসুমে সিলেটের বাতাসে পিএম২.৫ (অদৃশ্য ভাসমান কণা) ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অর্থাৎ বায়ুদূষণে দেশের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় পড়েছে সিলেট। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, গত ৯ জুন সিলেট নগরীর বাতাসে একিউআই ছিল ২৪৯, যা গত বছর ১৮ ডিসেম্বর ছিল ২৮৫। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে চলতি ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত একিউআই ছিল ২০০-এর ওপরে। সেই হিসেবে গত ডিসেম্বর থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল অস্বাস্থ্যকর। গত বছরের নভেম্বর থেকে কয়েক দিন ছাড়া দূষণ পরিস্থিতি ছিল ক্ষতিকর।
কৃষিপ্রধান অঞ্চল রংপুর। সেখানকার বাতাসেও বিপদ বাড়ছে।
গত ১৪ ডিসেম্বর এই বিভাগীয় শহরের একিউআই ছিল ৪৩৫, যা দেশের সবচেয়ে বেশি। ওই দিন এই শহরটি দূষণমাত্রায় সব শহরকে ছাড়িয়ে যায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায় বলেন, রংপুরে ছয় লেন মহাসড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর নির্মাণকাজ চলছে। রাস্তার ধারে ইট, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি নির্মাণসামগ্রী রাখা হচ্ছে। ফলে যান চলাচলের সময় বাতাস দূষিত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ থেকেও অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা এসে বাংলাদেশের বায়ু দূষিত করছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাঁটা, রাইস মিলের ধোঁয়া থেকেও দূষণ বাড়ছে। এর চেয়ে কিছুটা কম বা বেশি দূষিত দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর এবং অনেক জেলা শহরও।
সরকারে নেই সমন্বয়, অভাব আছে আইনেরও
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, মূলত সরকারি বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে নেই কার্যকর কোনো আইনও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট হওয়ার কথা ছিল। এটি হলে আইনগতভাবে শক্তিশালী অবস্থা তৈরি হতো। তা না হয়ে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ হয়েছে, যা তুলনামূলক কম কার্যকর, কম শক্তিশালী।
রাজধানীর বায়ুমান নিয়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন এখনও দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে রাজধানী, তা জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু আমাদের উদ্যোগ থাকলেও সিটি করপোরেশন, ট্রাফিক বিভাগসহ অন্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা পাওয়া যায় না। কেউ আমাদের কথা শোনে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরে অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়ক ও যানবাহন থেকে বায়ুদূষণ কমাতে সিটি করপোরেশন, সড়ক, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তবে আশার কথা, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এ কমিটির মাধ্যমে সকল সংস্থাকে সমন্বয় করা সম্ভব হবে।’
বায়ুদূষণ রোধে বিশ্বব্যাংকের টাকা
সম্প্রতি বায়ুদূষণ রোধে বিশ্বব্যাংক আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জানিয়ে মো. জিয়াউল হক বলেন, এ থেকে ৫০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্লক ইট উৎপাদনে ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। যানবাহন থেকে কী পরিমাণ দূষণ হচ্ছে, তা নির্ণয়ে বিআরটিএতে একটি ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন টেস্ট স্থাপন করা হবে। তখন গাড়ির ফিটনেস সনদ নিতে হলে যাচাই করে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। মান-উত্তীর্ণ না হলে ফিটনেস সনদ পাবে না কোনো গাড়ি। এ ছাড়া বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে বলেও জানান তিনি।
সুরক্ষা পেতে ব্যক্তিগত করণীয়
বায়ুদূষণজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে বাইরে বের হলে মাস্ক পরার পরামর্শ দেন ডা. আয়েশা আক্তার। তা ছাড়া ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ঘরের দরজা-জানালা যতখানি সম্ভব বন্ধ রাখা দরকার। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামীতে স্বাস্থ্যগত জটিলতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।