অর্থনীতিতে ব্যাংকের গুরুত্ব, বিশেষ করে সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের গুরুত্ববিষয়ক গবেষণার মাধ্যমে এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনজন। তারা হলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ বেন এস বার্নানকে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ।
গতকাল রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। এ সময় প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেস কমিটির চেয়ারম্যান টোরে ইলিংসেন বলেন, তিন অর্থনীতিবিদ আমাদের গুরুতর সংকট মোকাবেলার পাশাপাশি ব্যয়বহুল বেইলআউট এড়ানোর উপায় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার ভাগ করে নেবেন তারা। এটি মূলত অর্থনীতিতে নোবেল স্মারক পুরস্কার বা আলফ্রেড নোবেল স্মৃতি রক্ষার্থে অর্থনীতিতে ভেরিজ রিকসব্যাংক পুরস্কার হিসেবে পরিচিত।
গতকাল নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বেন এস বার্নানকে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ গবেষণা করেছেন ব্যাংক ও আর্থিক সংকট নিয়ে। অর্থনৈতিক সংকটকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের সমাজ কীভাবে খাপ খাইয়ে চলে এবং তা মোকাবেলা করে গবেষণায় নতুন একটি দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে তারা তা তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংকগুলোর ভূমিকাবিষয়ক আমাদের বোঝাপড়াগুলোকেও তারা সমৃদ্ধ করেছেন। আর্থিক সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর পতন এড়ানো কেন গুরুত্বপূর্ণ—এটি তাদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
বেন এস বার্নানকের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষে তিনি ১৯৭৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে অর্থনীতির ওপর পিএইচডি নেন। ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের ১৪তম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে মূলত বৈশ্বিক আর্থিক সংকট বা ২০০৭-০৮ আর্থিক সংকট পরিস্থিতি মোকাবেলা করে গোটা বিশ্ব। চেয়ারম্যান হিসেবে তার মেয়াদকালে বেন এ আর্থিক সংকটের বিপরীতে ফেডারেল রিজার্ভের পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়াগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ও তত্ত্বাবধানবিষয়ক পারদর্শিতার জন্য ২০০৯ সালে টাইম পারসন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন তিনি। ফেডের দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর্থিক নীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, অর্থনৈতিক ইতিহাসসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর নিবন্ধ ও একাডেমিক বই লিখেছেন। তার লেখা দুটি গ্রন্থ বর্তমানে পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত।
বেন এস বার্নানকের মতো একই বছর জন্মগ্রহণকারী ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অব বিজনেসের ফাইন্যান্সের অধ্যাপক। তিনি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী, আর্থিক সংকট এবং তারল্য গবেষণাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত আর্থিক সংকট ও ‘ব্যাংক রান’বিষয়ক কাজগুলোর জন্য।
উল্লেখ্য, ব্যাংক রান সংঘটিত হয় যখন একটি নির্দিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা একটি ব্যাংকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রাহক আমানত উত্তোলন শুরু করে এ ভয়ে যে ব্যাংকের অর্থ শিগগিরই ফুরিয়ে যেতে পারে।
এ বছর অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী আরেক বিজ্ঞানী ফিলিপ এইচ ডিবভিগের (জন্ম মে ১৯৫৫) সঙ্গে মিলে ডব্লিউ ডায়মন্ড আর্থিক সংকট ও ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বিষয়ক একটি মডেল প্রকাশ করেন, যা প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালের দিকে। মডেলটি ডায়মন্ড-ডিগভিগ মডেল নামে পরিচিত। ডিগভিগ সম্পদের মূল্য নির্ধারণ, বিনিয়োগ এবং করপোরেট গভর্ন্যান্সবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ডায়মন্ড-ডিগভিগ মডেলটি দেখায় যে কীভাবে ব্যাংকের তরল সম্পদের মিশ্রণ (যেমন ব্যবসায়িক বা বন্ধকি ঋণ) এবং তরল দায় (আমানত যা যেকোনো সময় প্রত্যাহার করা যেতে পারে) আমানতকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্কের জন্ম দিতে পারে।
বেন, ডায়মন্ড ও ডিগভিগ এ তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণা মূলত সংকটের সময় অর্থনীতিতে ব্যাংকের গুরুত্ব তুলে ধরে। পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার বিপদগুলো সম্পর্কেও ধারণা দেয়।
প্রতি বছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা শুরু হয়। এ ধারাবাহিকতায় চলতি বছর নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা শুরু হয় ৩ অক্টোবর থেকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পান সুইডেনের সোয়ান্তে প্যাবো। অণু জুড়ে ফেলার সহজ পদ্ধতি দেখিয়ে রসায়নে নোবেল জয় করেন ক্যারোলিন আর বার্তোজ্জি, মর্টেন মেলডাল ও কে ব্যারি শার্পলেস। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণার জন্য ফ্রান্সের অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট, আমেরিকার জন এফ ক্লজার ও অস্ট্রিয়ার অ্যান্টন জেলিঙ্গার জিতে নেন পদার্থে নোবেল। আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যকর্মের জন্য সাহিত্যে নোবেল পান ফরাসি লেখক আনি এর্নো। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন বেলারুশের মানবাধিকার কর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়ািস্ক এবং রাশিয়ার সংগঠন মেমোরিয়াল ও ইউক্রেনের সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ। গতকাল অর্থনীতিতে নোবেল ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয় নোবেল কার্যক্রম।