কানাডায় বাংলাদেশীদের অবস্থান দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। রাজনীতি, চাকরি ও ব্যবসায় বাঙালিরা নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করছেন। রাজনীতিতে বাংলাদেশী হিসেবে ডলি বেগমের সাফল্য এসেছে বেশ কয়েক বছর আগে। তার পথ ধরে অনেক বাংলাদেশী এখন কানাডার মূলধারার রাজনীতিতে ফাইট দিচ্ছেন। কেউ কেউ রাজনীতিবিদ হিসেবে সফলতার কাছাকাছি চলে এসেছেন। ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে এখন বাংলাদেশী প্রার্থীদের দেখা মেলে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যেও ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বাংলাদেশীরা। কানাডার জনপ্রিয় কফিশপ টিম হর্টনের প্রায় ২০টি ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনেছেন ইকবাল। এছাড়া ডমিনাস পিজা, পিজা পিজাসহ বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক এখন বাংলাদেশীরা। নামি মিষ্টির দোকান প্রিমিয়াম সুইটস কানাডার অন্টারিও প্রদেশে বেশ নাম করেছে। মোটা দাগে বলতে গেলে ব্যবসায়ী হিসেবে বাংলাদেশীরা কানাডার মূলধারার সঙ্গে বেশ ভাল ভাবেই মিশে গিয়েছেন। ফিজিশিয়ান হিসেবে আরিফ ও তরুণসহ অনেক বাংলাদেশী কানাডার স্বাস্থ্যসেবা সেক্টরে নিজেকে পরিচিত করে তুলেছেন। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অন্টারিও প্রদেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী কানাডিয়ান বসবাস করেন। এর মধ্যে জিটিএ (গ্রেটার টরন্টো এরিয়া) এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বসবাস করেন। স্কারবরো ও ইস্ট ইয়র্কে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বসবাস করছেন। ইস্ট ইয়র্কের বাংলা টাউন হিসেবে খ্যাত ডেনফোর্থে গেলে মনে হবে যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। সবাই বাংলায় কথা বলছেন। মারহাবা, নিশিতা ও সরকারসহ বিভিন্ন গ্রোসারিতে পছন্দের দেশী বাজার করছেন। মক্কা, ঘরোয়াসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ঝালমুড়ি, চা, চটপটি, তেহারি গিলছেন। কানাডার সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে বাংলাদেশীরা নিজের জায়গা বেশ পোক্ত করে ফেলেছেন। টরন্টো সিটি, মারখাম সিটি, ডারহাম রিজিয়নসহ বিভিন্ন রিজিয়নে বাংলাদেশীরা চাকরি করছেন। এর বাইরে কানাডার জনপ্রিয় টিডি, আরবিসি, স্কশিয়াসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীরা চাকরি করছেন।
কানাডার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে। কানাডার রাজনীতিতে এখন বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য অর্জনের পরিসংখ্যান বেশ উজ্জ্বল। স্থানীয় পর্যায়ে তো বটেই, দেশটির জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে এসেছেন অনেকে। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ফেডারেল নির্বাচনে আটজন বাংলাদেশী-কানাডিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরা সবাই ক্ষমতাসীন দল লিবারেল পার্টি, কনজারভেটিভ পার্টি, এনডিপি ও গ্রিন পার্টির সদস্য। যদিও ২০১৫ সালে প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একমাত্র প্রার্থী ছিলেন খালিশ আহমেদ। তবে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর নির্বাচনে তিনজন প্রার্থী খালিশ, আফরোজা ও ফাইজ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন আরো পাঁচজন। ফেডারেল নির্বাচনে সে সংখ্যা বেড়ে আটে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ ফেডারেল নির্বাচনে বাংলাদেশী-কানাডিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা হলেন সৈয়দ মহসিন, মহসিন আহমেদ, নামির রহমান, সনি মীর, খালিস আহমেদ তমাল, ফাইজ কামাল, গুলশান আক্তার ও আফরোজা হোসেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ মহসিনের বাংলাদেশে রাজনীতি করার ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। ২০১৫ সালে কানাডার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে খালিশ প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হিসেবে ইতিহাস গড়েন। এনডিপির পক্ষে ক্যালগেরি সিগন্যাল হিল আসন থেকে অংশ নিয়ে খালিশ আহমেদ সেবার হেরে যান কনজারভেটিভ পার্টির রন লিপার্টের কাছে। এতে অবশ্য খালিশ আহমেদের ওপর আস্থা হারায়নি তার দল। এর পরও তাকে একই আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছে এনডিপি। এছাড়া এনডিপি আরেক বাংলাদেশী-কানাডিয়ান ফাইজ কামালকে নতুন করে মনোনয়ন দেয়। অন্টারিওর স্কারবরো সেন্টার আসনে লড়েন তিনি। এছাড়া ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি থেকে মনোনয়ন পান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আফরোজা হোসেন। টরন্টো থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের শহর অশোয়া থেকে লড়েন তিনি। জিততে না পারলেও ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম যুক্ত করেন। কারণ লিবারেল পার্টি থেকে প্রথম কোনো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফেডারেল নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। সর্বশেষ ফেডারেল নির্বাচনে অংশ নেয়া খালিশ আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন। তিনি পেশায় একজন ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি ব্যবসায়ী। বর্তমানে কানাডার এই খ্যাতিমান ভূতাত্ত্বিক প্রায় দুই যুগ ধরে নরওয়ে ও কানাডার ক্যালগেরির বিভিন্ন তেল ও গ্যাস কোম্পানিতে জিও সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। এনডিপির আরেক প্রার্থী ফাইজ কামাল কানাডায় বাংলাদেশী অভিবাসী পরিবারের সন্তান। বিজনেস অপারেশন অ্যানালিস্ট হিসেবে ফাইজ কাজ করেন বিখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিএমে। এর আগে তিনি বিখ্যাত ফ্যাশন পণ্যের ব্র্যান্ড এলজিএফজির হয়ে কাজ করেছেন এস্তোনিয়া, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৮ সালের অন্টারিও প্রাদেশিক নির্বাচনে স্কারবরো সাউথওয়েস্ট থেকে বিজয়ী বাংলাদেশী এমপিপি (প্রাদেশিক এমপি) ডলি বেগমের নির্বাচনী প্রচারণা দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেন তিনি। সে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কানাডিয়ান পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপিপি হন ডলি বেগম। ফাইজ কামাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও লিবারেল পার্টির এমপি সালমা জাহিদ এবং কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী এরশাদ চৌধুরীর সঙ্গে। লিবারেল পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আফরোজা হোসেন প্রায় ৩০ বছর আগে স্বামী মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে অভিবাসী হয়ে কানাডায় আসেন। এর আগে তিনি পড়াশোনা করেন ঢাকার মোহাম্মদপুর গার্লস স্কুল ও পরে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে। কানাডায় পাড়ি জমানোর পর তিনি ডারহাম কলেজ থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিপ্লোমা ও পরে অন্টারিওর বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে কমার্সে অনার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে একটি বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে আর্থিক ব্যবস্থাপক (ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজার) হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি কানাডিয়ান সেনস সোসাইটি, হিউম্যান রাইটস, রিফিউজি পুনর্বাসনসহ অন্তত ১৩টি সংগঠনে স্বেচ্ছাশ্রম (ভলান্টিয়ার) দিচ্ছেন। ব্যক্তি জীবনে আফরোজা হোসেন একজন পেশাদার অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এদিকে এ বছর জুনে অনুষ্ঠিত কানাডার প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে তিনজন বাংলাদেশী কানাডিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এদের মধ্যে স্কারবরো সাউথওয়েস্ট থেকে ডলি বেগম টানা দুবার প্রভিন্সিয়াল সরকারের এমপি নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, এনডিপির অন্টারিও প্রভিন্সের ডেপুটি লিডার নির্বাচিত হয়েছেন। ডলি বেগম ছাড়াও ফারহিন আলম ও কানিজ মৌলি এমপিপি পদে নির্বাচিত হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ডলি বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতে যান দ্বিতীয়বার। অন্য দুই প্রার্থী বেশ ভালভাবেই ফাইট দেন। ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচন ছাড়াও ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর কানাডার ক্যালগেরির সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে একমাত্র প্রবাসী বাঙালি মিজানুর রহমান মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। এছাড়া স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশী-কানাডিয়ানরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ব্যবসায়ও এগিয়ে বাংলাদেশী-কানাডিয়ানরা। কানাডায় দিন দিন বাড়ছে অভিবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা। একসময় বিভিন্ন শহরে ভারতীয়সহ অন্য দেশের অভিবাসীরা একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও দৃশ্যপট পাল্টেছে। ব্যবসা করে অনেক বাংলাদেশী এরই মধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। বিভিন্ন মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা ছাড়াও বাংলাদেশীরা রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, মিষ্টির দোকান, পিঠাঘর, বুটিক শপসহ নানা রকম পসরা সাজিয়ে দোকান খুলে বসেছেন। কানাডায় বর্তমানে বাংলাদেশীর সংখ্যা কত তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। তবে সব মিলিয়ে কানাডায় বাংলাদেশীর সংখ্যা তিন-পাঁচ লাখ বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আর এ সংখ্যা বাড়ছে। কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরন্টোয় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী থাকেন। ৮০ হাজার থেকে এক লাখের মতো। কানাডার ব্যবসা ক্ষেত্রে অনেক বাংলাদেশী এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। দোকানসহ নানা ছোট ব্যবসা তো আছেই, বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টারও খুলেছেন বাংলাদেশীরা। এছাড়া ড্রাইভিং স্কুল পরিচালনা করছেন কয়েকজন বাংলাদেশী। শুধু নিজস্ব কমিউনিটি নয়, অন্য দেশের অভিবাসীরাও এখন তাদের কাস্টমার। বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট, সুইস বেকারি অ্যান্ড ফাস্টফুড, মক্কা রেস্টুরেন্ট, রেড হট তন্দুরি কাবাব অ্যান্ড কারি, লবঙ্গ, মমস কিচেন ও আড্ডা। গ্রোসারির মধ্যে মারহাবা সুপার মার্কেট, সরকার ফুডস, নিশিতা ফার্ম ফ্রেশ, চকবাজার ও তাজমহল গ্রোসারি উল্লেখযোগ্য। বুটিক হাউসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দেশী দশ ও শাড়ি হাউস। বর্তমানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় প্রচুর বাংলাদেশী অংশ নিচ্ছেন। কমিউনিটির অনেকেই বাড়ি কিনতে তাদের দেশীয় ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। টরন্টোয় বাংলাদেশী আইনজীবীও রয়েছেন, যারা বাড়ি কেনা থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশীদের মালিকানায় কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জও রয়েছে টরন্টোয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো আয়োজন করে থাকে। অনেকেই বাংলাদেশ থেকে জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে এসে সাংস্কৃতিক আয়োজন উপহার দেন সবাইকে। বাংলাদেশী সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে নাচ, গান, শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার স্কুলও পরিচালনা করছেন কয়েকজন। কানাডার বড় শহরগুলো থেকে বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক ভোরের আলো, বাংলা মেইল, বাংলা কাগজসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র বের হচ্ছে। এছাড়া প্রবাসী টিভি, নন্দন টিভি ও এনআরবি টিভিসহ বিভিন্ন আইপি টিভি চ্যানেল রয়েছে। বাংলাদেশীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর প্রয়োজনীয় তথ্যের খবরাখবর জানতে এখানকার পাঠকদের মধ্যেও বেশ আগ্রহ রয়েছে।