আকস্মিকভাবেই ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন, পেট্রলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে প্রায় ৫২ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। এর আগেও গত বছরের নভেম্বরে এক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। দীর্ঘদিন মুনাফায় থাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসানের চাপ কমাতে এ দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাবপত্র অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির কাছে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সংরক্ষিত আয় রয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরেও মে মাস পর্যন্ত মুনাফায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। আবার কোনো কোনো মহল বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও গত সাত বছরে বিপিসিকে কোনো ভর্তুকি দেয়নি সরকার।
বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য হলো, দীর্ঘদিন ধরে টানা মুনাফা করে যাওয়া বিপিসির অল্প কয়েক মাসের লোকসানের চাপ সামলাতে না পারার বিষয়টি দুঃখজনক। আবার আইএমএফের সঙ্গে আলোচনাও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের শর্ত দেয়ার পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়নি। সে হিসেবে আইএমএফের ঋণ পেতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকেও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। কারণ এখনো আইএমএফের সঙ্গে এ ধরনের কোনো আলোচনাই হয়নি।
বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মোট কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৩২ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিপিসির ৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয়েছে, যা পরের চার অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ৬ হাজার ৮১৮ কোটি, ৪ হাজার ২৫৪ কোটি, ৭ হাজার ৪৬৫ কোটি ও ১২ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ৮ হাজার ৪৪ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে, যা পরের চার অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি, ৩ হাজার ৯৮১ কোটি, ৫ হাজার ৬৫ কোটি ও ৯ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২৩ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা সংরক্ষিত আয় ছিল। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ মে পর্যন্ত বিপিসির ১ হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা নিট মুনাফা হয়েছে।
বিপিসির তথ্য বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে দৈনিক হারে লোকসানের মুখে পড়ে বিপিসি। বর্তমানে বিপিসি দৈনিক ৬০ কোটি টাকা করে লোকসান দিচ্ছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মে পর্যন্ত ৯৫ মাস লাভে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি মাত্র কয়েক মাসের লোকসানের ভার সামলাতে না পারার বিষয়টি দুঃখজনক। কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বব্যাপী টানা লকডাউন থাকার সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেকখানি কমে গেলেও বিপিসি মজুদ সক্ষমতার অভাবে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। আবার বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির যে চাপের কথা বলা হচ্ছে, সেটিও দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলার উঠলেও এখন তা কমতির দিকে রয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারের নিচে।
সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত বিপিসিকে কোনো ভর্তুকি দেয়নি বলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যে উঠে এসেছে। বরং গত পাঁচ বছরে বিপিসি শুল্ক, মূসক, আয়কর, লভ্যাংশ, বিবিধ খাতসহ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মোট সাড়ে ৪৬ হাজার কোটি টাকা জমা দিয়েছে। বিপিসি বিশ্ববাজার থেকে জ্বালানি আমদানি করে বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা করে সরকারকে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু তিন দফায় সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাসমূহের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন-২০২০’-এর ধারা ৪ ও ৫-এর বিধান অনুযায়ী বিপিসি তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ ‘কোয়াসি করপোরেশনের উদ্বৃত্ত আয়’ কোডের অধীনে জমা পড়েছে।