মতামত

কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ

বনাঞ্চল বিনাশ, ইকো সিস্টেম ধ্বংস, কৃত্রিম বন্যা এবং প্রাণীর আবাসস্থল উজাড়করণ

(ছবিগুলো তুলেছিলাম ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ চকরিয়া, ডুলাহজারা এলাকার বনাঞ্চল নিধন এলাকা থেকে) 
(ছবিগুলো তুলেছিলাম ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ চকরিয়া, ডুলাহজারা এলাকার বনাঞ্চল নিধন এলাকা থেকে)

চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি’র পূর্ব পার্শ্বে (বর্তমান রেলওয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, তাসফিয়া রেস্টুরেন্ট, গোয়াল পাড়া) সরকারী-বেসরকারী সংস্থার চুক্তিতে একটি বৃহৎ হাসপাতাল নির্মাণ করতে চাওয়ার প্রতিবাদে সমস্ত চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ও মিডিয়ায় শক্তিশালী আন্দোলন, প্রতিবাদ কর্মসূচী চলছে। কারণ, সিআরবি একটি নির্মল, সবুজাভ, স্বচ্ছ বিশুদ্ধ বাতাসের কারখানা। এখানে নগরবাসী নির্মল চিত্তবিনোদনের জন্য গমন করে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, হাসপাতাল নির্মান করলে শতবর্ষী বহু শিরিষ গাছ কাঁটা পড়বে। এই যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতিপক্ষ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আশা করা যায়, বুদ্ধিজীবি, বিভিন্ন সংগঠন, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদের ফলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসবে।

অতীতে আমরা দেখেছি, দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত স্থানে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে দূর্বার জনবিদ্রোহ হয়েছিল। সে আন্দোলনে অনেক সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সম্প্রতি প্রাণ দিয়েছে বাঁশখালীতে এস.আলম পাওয়ার প্লান্ট করতে না দিতে চাওয়া আন্দোলনে। যদিও কয়লা নির্ভর সেই পাওয়ার প্লান্ট এক ডজনের বেশি প্রাণের বিনিময়ে প্রায় নির্মাণ কাজ শেষের পথে। এছাড়া আরো দেখেছি সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিপক্ষে সারা দেশের মানুষের জনবিস্ফোরণ। মানুষ এখনো ঘৃণায় থু থু ফেলে। তবুও রামপাল পাওয়ার প্লান্টের কাজ প্রায় সমাপ্তির দিকে।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের বায়োজিদ লিংক রোড নির্মাণ করতে গিয়ে, জনমানুষের চোখের আড়ালে বা কেউ কেউ জানলেও না জানা ভান করার ফাঁকে মোটামুটি এক শত এর কাছাকাছি পাহাড় কেটে সমান করা সিডিএ(চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)  নিজেও সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছে শতবর্ষী গাছ কাটা গেলে পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে। অথচ বায়োজিদ সড়ক  প্রকল্পে পাহাড় কাটার অপরাধে পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল।
এর সরল মর্মার্থ হচ্ছে, অনেক প্রকল্প পরিবেশের ক্ষতি হলেও সরকারকে করতে হয় উন্নয়নের চাহিদা পূরণে। যদিওবা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ না করে অন্য স্থানে করলে তেমন কিছু আসে যাবে না। কিন্তু চট্টগ্রাম – দোহাজারী – ককসবাজার রেলপথ নির্মাণের কোন বিকল্প ছিল কি?
(ছবিগুলো তুলেছিলাম ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ চকরিয়া, ডুলাহজারা এলাকার বনাঞ্চল নিধন এলাকা থেকে) 
(ছবিগুলো তুলেছিলাম ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ চকরিয়া, ডুলাহজারা এলাকার বনাঞ্চল নিধন এলাকা থেকে)

এক কথায়- ছিল না।কক্সবাজার রেল সংযোগ ছিল কক্সবাজার বাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এতে বাংলাদেশের সর্ব শেষ এই পর্যটন স্বর্গের সাথে যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন হবে। পর্যটকদের সাথে সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এর সুফল ভোগ করবে বলে আশা প্রকাশ করা যায় নির্দ্ধিধায়।

প্রশ্নটা এখানে, একটা রেলপথ কি রাতারাতি নির্মাণ করা যায়? এর ফলে পরিবেশের উপর কতটুকু প্রভাব পড়ল?
আমি জানিনা আমার মনে উদয় হওয়া এই প্রশ্ন প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানে ধনাত্বক নাকি ঋণাত্বক। তবুও বারবার এই কথাগুলো আমার মনে উঁকি দেয়, নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করায়।
আমরা জানি, বাংলাদেশে যে কয়টি অভয়ারণ্য আছে, ততমধ্যে চুনতী রেঞ্জ অন্যতম। আমরা এও জানি, চট্টগ্রামের শেষ উপজেলা লোহাগাড়া হতে শুরু হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়া পর্যন্ত সমগ্র ককসবাজার জেলাটিই পাহাড় আর বনাঞ্চলে পূর্ণ।
রেলনির্মাণ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এই বনাঞ্চলের। যদি আমরা তুলনা দেই সিআরবি’র শতবর্ষী শিরিষ গাছের সাথে তবে আমি বলব, চুনতি, হারবাং, কচ্ছপের ঢালা, ডুলহাজারা অংশে যে লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে, তা ২/৩/৪ শ বছরের চেয়েও প্রবীণ বৃক্ষ। সাধারণ কাঠুরে দিয়ে সেই গাছ কাটা যায়নি, বৃক্ষ নিধণের জন্য মোটামুটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বড় করাত, কাটার, স্কেবেটার, ক্রেন ব্যবহার করতে হয়েছে। এগুলো কি প্রতিবাদের যোগ্য নয়? বাংলাদেশের কোন বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ কি একটা টুঁ শব্দ করেছেন এই শতবর্ষী লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ কর্তনের কারণে? অথচ, উনারাই একদিন রেলে চড়ে ককসবাজারে যেতে যেতে অন্য একটি সফট আন্দোলনের বিপক্ষে স্ট্যাটাস দেবেন।
এরপরে ধ্বংস হয়েছে পাহাড়। শত শত পাহাড়, টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রানীদের বাসস্থান। নষ্ট করা হয়েছে বুনো হাতিদের পথ চলাচল। নষ্ট হয়েছে সেই অঞ্চলের ইকো সিস্টেম। নষ্ট হয়েছে অভিযোজিত পরিবেশ।
(ছবিগুলো তুলেছিলাম ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ চকরিয়া, ডুলাহজারা এলাকার বনাঞ্চল নিধন এলাকা থেকে) 
(ছবিগুলো তুলেছিলাম ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ চকরিয়া, ডুলাহজারা এলাকার বনাঞ্চল নিধন এলাকা থেকে)

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ থেকে ৫ বছর আগে একটি সভায় বলেছিলেন, আবাদি জমি নষ্ট করে কোন উন্নয়ন নয়। প্রতিফলন কি পেলাম? লক্ষ লক্ষ হেক্টর আবাদী জমি ভরাট করা হয়েছে কোটি কোটি ঘনফুট পাহাড়ের মাটি দিয়ে। রেলের স্লিপার বসানোর জন্য রাস্তা এত ঊঁচু আর প্রশস্ত করা হয়েছে, যেন নূহ (আঃ) নৌকা। কেউ ছুঁতে পারবে না। এই ঊঁচু বাঁধের কারণে ককসবাজার অঞ্চলে এখন কৃত্রিম বন্যা হচ্ছে। পানি চলাচলের পর্যাপ্ত পথ না থাকার কারণে জীবনে যাদের উঠানে পানি উঠেনি, তাদের ঘরে গলা পানি। কৃত্রিম বন্যার ফলে নতুন লাগানো বীজধানের চারা ধ্বংস হয়েছে। আগামী সিজনের আশানুরূপ ফসল তুলতে পারবে কিনা সন্দেহ। একদিকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামাম, অপর দিকে আমরা নিজেরাই কৃষির ক্ষতি করছি।

এতদ সমস্ত কৃতকলাপ হচ্ছে, সবই লোক চক্ষুর অন্তরালে। কারণ রেল লাইনটা বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষ যায় না। স্থানীয় মানুষজন এ সম্পর্কে সচেতন নয় আর সচেতন হলেও কিছু বলার ভাষা শক্তি নাই।
যারা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তারা কি সচেতন নয়? যে ইঞ্জিনিয়ার এই রেলপথের ডিজাইন করেছে তারা কি জানে না এখানে লক্ষ লক্ষ শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে, পাহাড় কাটা যাবে? জানে। তবুও তারা নির্মম। এতে তাদের কিছু যায় আসে না। হয়তো দেখা যাবে, এই গাছ যারা কাটার অনুমতি দিল, সে সমস্ত ইঞ্জিনিয়ার, কর্মকর্তাদের বাসার ছাদে বাগান করা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে  তারা বা তাদের পরিবার পরিবেশ প্রেমী। এই যে হাজার হাজার প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা ইঞ্জিনিয়ারগণের বাসায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারা বিড়াল প্রেমী। পাখি প্রেমী। বাসার খাঁচায় পাখি লালন পালন করে।
এটাই নির্মম বাস্তবতা। কিছু প্রশ্ন কেউ করে না। আবার কিছু প্রশ্ন স্রোতে তাল মেলাতে করে। এই দ্বৈত চরিত্রের কারণেই দেশের বৃহত্তর ক্ষতির খোঁজ কেউ রাখছে না। কিভাবে পরিবেশকে বাঁচিয়ে, লক্ষ লক্ষ শতবর্ষী গাছ না কেটে, আবাদী জমি ভরাট না করে, শত শত পাহাড় না কেটে, বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে রেলপথটা নির্মাণ করা যেত, সেই কথা বলতে কেউ এগিয়ে এলো না।
সবাই নোয়াখালীতে গান্ধীজীর ছাগল চুরি কেন হলো সে নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু গান্ধীজী কেন নোয়াখালী এসেছিল সে কথা শুনতে চায় না।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button