দেশহাইলাইটস

যে কারণে মাওয়া-জাজিরায় তৈরি হলো পদ্মা সেতু

শরীয়তপুরের জাজিরা আর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ার মধ্যে তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী ভারত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা। সেখান থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলেছে। দুই নদী এক হয়ে পদ্মা নাম নিয়ে বয়ে গেছে চাঁদপুর পর্যন্ত। চাঁদপুরে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলে মেঘনা নামে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করেছে মূলত পদ্মার রাজবাড়ী-চাঁদপুর অংশ। এ অংশের শরীয়তপুরের জাজিরা আর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ার মধ্যে তৈরি হয়েছে দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু। তবে পদ্মা সেতুর পরিকল্পনায় বিবেচিত হয়েছিল আরো তিনটি স্থান। নির্মাণ ব্যয়, আর্থিক লাভ-ক্ষতি, যান চলাচলের হিসাব-নিকাশ, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় শেষমেশ পদ্মা সেতুর স্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয় মাওয়া-জাজিরাকে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, শুরুর পরিকল্পনায় পদ্মা সেতুর জন্য মাওয়া-জাজিরা ছাড়াও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ, দোহার-চরভদ্রাসন ও চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জকে সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাদ পড়ে দোহার-চরভদ্রাসন ও চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ। বাদ পড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, এ দুই স্থানে পদ্মার প্রশস্ততা অনেক বেশি। সেতু করলে তার দৈর্ঘ্য হতো কম-বেশি ১০ কিলোমিটার। এদিক থেকে কাছাকাছি অবস্থানে ছিল মাওয়া-জাজিরা ও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ। এসব পথের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার বা এর কাছাকাছি।

পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতু মাওয়া-জাজিরা নাকি পাটুরিয়া-গোয়ালন্দের মধ্যে হবে তা ঠিক করতে ভৌত, কারিগরি, অর্থনৈতিক, স্থানীয় অবকাঠামো, সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়। স্থান দুটি চূড়ান্ত করতে মোটা দাগে আরো চারটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়।

এর প্রথমটি হলো অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা। এজন্য স্থান দুটির ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন, বেনিফিট/কস্ট রেশিও, নিট প্রেজেন্ট ভ্যালু বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয়টি হলো অর্থনৈতিক ব্যয়। এক্ষেত্রে সাইট দুটিতে সেতু তৈরি হলে তার নির্মাণ ব্যয় এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মূল্যায়ন করা হয়। তৃতীয় যে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয় তা হলো আঞ্চলিক উন্নয়ন। সেতু তৈরি হলে তা আঞ্চলিক জিডিপি কতটা বাড়াবে এবং তা কী পরিমাণ দারিদ্র্য কমাতে ভূমিকা রাখবে তা বিবেচনা করা হয়। চতুর্থ ধাপে বিবেচনা করা হয় বিভিন্ন সামাজিক বিষয়। পাশাপাশি কোন এলাকায় সেতু হলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ব্যয় কেমন হবে, তাও আমলে নেয়া হয়।

এসব বিষয় বিবেচনা করে দেখা যায়, মাওয়া প্রান্তে পদ্মা নদীর তীর স্থিতিশীল হওয়ায় নদীশাসনে খরচ কম হবে। আবার মাওয়া-জাজিরার মধ্যে সেতু তৈরি হলে যানবাহনও বেশি চলতে পারবে। আঞ্চলিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে সামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশগত নানা দিক বিবেচনা করে পদ্মা সেতুর জন্য সবচেয়ে আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয় মাওয়া-জাজিরা পথকে।

মাওয়া-জাজিরা ও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ—দুটি স্থানই সেতুর জন্য সমান দূরত্বের ছিল উল্লেখ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্যানেল অব এক্সপার্ট টিমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, দূরত্ব সমান হলেও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দে পাইলিংয়ের কাজটা জটিল হতো। বিপরীতে মাওয়া প্রান্তের পদ্মা নদী তুলনামূলক বেশি স্থিতিশীল। আবার ঢাকা থেকে পাটুরিয়ার চেয়ে মাওয়ার দূরত্ব কম। কোনো প্রকল্পের যখন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়, তখন অনেক বিষয় খতিয়ে দেখা হয়। কোন জায়গা দিয়ে সেতু করলে সুবিধা হবে, সেই জায়গার মাটির গুণগত মান কেমন, সেতুর কাঠামো কোন জায়গায় ভালো হবে প্রভৃতি বিষয় দেখা হয়। সব দিক বিবেচনা করে পদ্মা সেতুর জন্য স্থান হিসেবে মাওয়া-জাজিরাকে চূড়ান্ত করার কথা জানান তিনি।

২০১৪ সালের শেষভাগে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে বর্তমানে একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। ২৫ জুন সকাল ১০টায় সেতুটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে আপাতত সেতুতে ট্রেন চলবে না। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইনের নতুন ব্রড গেজ রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে। রেলপথটির কাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে এর আগেই ঢাকা-ভাঙ্গা অংশ চালু করে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরুর পরিকল্পনার কথা আগেই জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

সমীক্ষা অনুযায়ী, চালুর পর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। একইভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা, যার পুরোটাই বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button