চলতি মাসে উদ্বোধন হতে যাওয়া পদ্মা সেতুর প্রভাবে বদলে যাবে ফরিদপুরের কৃষি অর্থনীতি। বিশেষ করে ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষিদের আগামী মৌসুমে লাভ হবে ৭০ থেকে ৭৩ কোটি টাকা। সারাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই জেলা রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে শুধু সালথা ও নগরকান্দাতেই যে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়, তা বাকি সাত উপজেলার সমান। তবে পচনশীল এই মসলাজাতীয় উদ্ভিদটি বাধ্য হয়েই অনেক সময় কম দামে বিক্রি করে দিতে হতো প্রান্তিক চাষিদের, যেটা আগামী মৌসুম থেকে আর করতে হবে না বলে আশা করছেন তারা। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে যানজট আর ভোগান্তি ছাড়াই রাজধানীসহ সংলগ্ন বিভিন্ন জেলাতে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারবে সালথা-নগরকান্দা তথা ফরিদপুর জেলার পেঁয়াজ।
সরেজমিন গত সোমবার সালথা উপজেলার কয়েকটি এলাকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত দুই বছরে মাঠের কৃষক এক মণ পেঁয়াজের দাম পেয়েছে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। খুব ভালো মানের পেঁয়াজ হলে সর্বোচ্চ পেয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা। দুই ধরনের পেঁয়াজ চাষ হয় ফরিদপুরে। বেশিরভাগই হালি জাতের। আর কিছু চাষ হয় মুড়িকাটা জাতের। এই জাতটি দ্রুত পচনশীল বলে কম দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। অনেক সময় চাষিদের উৎপাদন খরচও ওঠে না। হালি জাতটিও বৃষ্টির পানি পেলে বা শুস্ক স্থানে সংরক্ষণ করা না গেলে পচে নষ্ট হয়। ফলে যাদের সংরক্ষণের জায়গা নেই তারা বাধ্য হয়েই কম লাভে অথবা উৎপাদন মূল্যে মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পদ্মা সেতু দিয়ে এই অঞ্চলের পেঁয়াজ রাজধানীতে চলে যাবে দু’ঘণ্টার মধ্যেই। ফলে কেউ আর কম দামে পেঁয়াজ বাজারে ছেড়ে দেবে না বা পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থাকবে না। এতে মণপ্রতি ৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি পাবে প্রান্তিক কৃষক, তাদের মুখে ফুটবে হাসি এবং আরও বেশি চাষি পেঁয়াজ আবাদে উৎসাহী হবে।
সালথা উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের জয়ঝাপ গ্রামের আবু নাসের জানান, বর্তমানে রাজধানীতে পেঁয়াজ পৌঁছানোই চাষিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মাওয়া কিংবা পাটুরিয়া ঘাটে দিনের পর দিন ট্রাক যানজটে আটকে থাকে। ফলে খরচ বেড়ে যায়। আর পচার ভয় তো থাকেই। অনেক সময় যে খরচ হয় পথে, তা বিক্রি করেও ওঠে না। পদ্মা সেতু চালু হলে পথে যে অতিরিক্ত টাকা খরচ হবে, সেই টাকাও যাবে কৃষকের পকেটে। পচার ভয়ও থাকবে না।
সালথার রামকান্তপুর এলাকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সুনীল দাস মনে করেন, পদ্মা সেতু দিয়ে পেঁয়াজ দেশের অন্যান্য মোকামে দ্রুত পৌঁছে যেতে পারবে। তাতে করে ফরিদপুরের ছোট-বড় সব পেঁয়াজ ব্যবসায়ীই লাভবান হবে। ব্যবসায় গতি আসবে, বাড়বে লেনদেন। তবে কৃষককে লাভবান করতে হলে পেঁয়াজের দাম মণপ্রতি ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা করার দাবি জানান তিনি।
একই দাবি নগরকান্দার ঈশ্বর্দী গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান মোল্লার। তিনি বলেন, এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করে পৌনে ৩০০ মণ পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে বাজারদর মণপ্রতি হাজার টাকা। এতে কৃষকের খরচের পয়সাও ওঠে না। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হলে মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি সুবিধা করতে পারবে না। বাজারে দাম বেশি থাকলে তার ভাগ কৃষকের পকেটেও ঢুকবে, কেউ জিম্মি করে কম দামে কৃষকের পেঁয়াজ কিনতে পারবে না। সালথা উপজেলার বিভাগদী গ্রামের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, ট্রাকে ঢাকার বাজারে পেঁয়াজ নিতে খরচ পরে কেজিপ্রতি ১ টাকা ৫০ পয়সা। ১০ টনের একটি ট্রাকে পেঁয়াজ বোঝাই করে ঢাকা পাঠাতে ব্যয় হয় ১৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হলে ১০ হাজার টাকায় ট্রাক ভাড়া পাওয়া যাবে। ফলে কেজিপ্রতি দেড় টাকার জায়গায় খরচ নেমে আসবে এক টাকায়। আগে ট্রাক ভাড়া নিয়ে তিন-চার দিন আটকে থাকত ফেরিঘাটে বা জ্যামে, এখন প্রতিদিনই তারা ঢাকায় মাল নামিয়ে
আবার ফিরে আসতে পারবেন। ফলে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা টাকা এবং সময় দুই দিক থেকেই লাভবান হবেন। ফরিদপুর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে পেঁয়াজ চাষির সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। তাদের প্রতি মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করতে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। পেঁয়াজের গত পাঁচ বছরের আবাদ ও উৎপাদন নিয়ে কথা হয় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে ফরিদপুরে পেঁয়াজের আবাদ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলায় ৩৪ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৯ হাজার ৪৪০ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে উৎপাদিত হয় ৫ লাখ টন। চলতি বছর জেলায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ ফলেছে সাড়ে ৫ লাখ টন। মণপ্রতি ৫০ টাকা লাভ হলে আগামী মৌসুমে ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষিদের লাভ হবে অন্তত ৭০ কোটি টাকা।