আপনি জানেন কি?

যে কারণে বিশেষ হয়ে ওঠে দার্জিলিং চা

632চায়ের গুণাগুণ নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই দার্জিলিং চায়ের নাম আসে। দার্জিলিং চায়ের মূল বৈশিষ্ট্য এতে অন্য কোনো জাতের মিশ্রণ নেই। স্বাদ স্বতন্ত্র। কখনো কখনো দার্জিলিং চা-কে নতুন তৈরি মুদ্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়। ঝকঝকে। বিশেষ সুগন্ধ, স্বাদ দার্জিলিং চায়ের বৈশিষ্ট্য। চা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন এপ্রিকট, পিচ, মাসকাট আঙ্গুর ও ভাজা বাদামের মিলিত স্বাদ ধারণ করে দার্জিলিং চা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত স্বাদের এ চা বিশ্বের প্রিমিয়াম চা হিসেবে বিবেচিত। অন্য কোনো অঞ্চলের চায়ে এ স্বাদ পাওয়া যায় না। দার্জিলিং চা অনেক ক্ষেত্রে ‘চা জগতের শ্যাম্পেন’ বলে অভিহিত হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে দার্জিলিংয়ের চায়ের স্বাদ ভিন্ন আর স্বতন্ত্র হওয়ার কারণ কী? এমনকি একই চারা অন্য অঞ্চলে রোপণ করা হলে সে চায়ের স্বাদ দার্জিলিং চায়ের মতো হয় না। এ বিষয়ে দার্জিলিংয়ের একটি চা বাগানের ম্যানেজারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘আপনি দার্জিলিংয়ে যেটা উৎপাদন করবেন, সেটাই হবে দার্জিলিং চা। একই গাছ আপনি দক্ষিণ ভারতে রোপণ করলে সেটা দক্ষিণ ভারতের চা হবে।’ অর্থাৎ, দার্জিলিং চায়ের মূল বৈশিষ্ট্য বা এর স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার কারণ খোদ দার্জিলিং—তথা দার্জিলিংয়ের মাটি ও আবহাওয়া। চা চাষে যে ধরনের আবহাওয়া প্রয়োজন—দিনে সর্বোচ্চ ৫-৬ ঘণ্টা সূর্যালোক, পাহাড়ি আর্দ্রতা, কুয়াশা ও মেঘ, যা কিনা সরাসরি সূর্যতাপ থেকে চায়ের পাতাকে রক্ষা করে—দার্জিলিং ঠিক সে রকম আবহাওয়ার একটি অঞ্চল।

ভারতীয় উপমহাদেশে চা জনপ্রিয় হয় ব্রিটিশ আমলে। পানীয় হিসেবে জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে চায়ের আর্থিক গুরুত্ব অনেক। চায়ের চাষ, বাজারজাতকরণ ও চা শিল্পের ক্ষেত্রে ভারতে দার্জিলিং শহরের ভূমিকাই সর্বাধিক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে দার্জিলিংয়ে চা শিল্প গড়ে ওঠে। নানা ধরনের ব্যবসা বিস্তারের চিন্তার মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চায়ের ব্যবসা নিয়েও সচেতন ছিল। ১৮৩৪ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একটি কমিটি করে ভারতে চা চাষের উপযোগিতা নিয়ে একটি রিপোর্ট করার নির্দেশনা দেন। বেন্টিঙ্কের এ কমিটি কাজ শুরু করার বেশ আগে, ১৮২১ সালে মেজর ব্রুস ও ১৮২৪ সালে মি. স্কট আসামে বুনো চা গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু কমিশনের দ্বারা চা চাষের জন্য চীন থেকে উচ্চমানের বীজ এবং চাষ প্রশিক্ষণের জন্য চীনাম্যান আনা হয়।

দার্জিলিংয়ে চায়ের রাজ্য তৈরির কৃতিত্ব অনেকটাই ডা. ক্যাম্পবেলের। শুরুটা তিনি করেছিলেন। ১৮৪০ সালে কাঠমান্ডু থেকে বদলি হয়ে ক্যাম্পবেল দার্জিলিংয়ে আসেন। এখানে তিনি নিরীক্ষামূলক চা চাষ শুরু করেন। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া ছিল চা চাষের উপযুক্ত। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই চা গাছ দ্রুত বাড়তে দেখা যায়। এ সময় আরো অনেকে ডা. ক্যাম্পবেলকে অনুসরণ করে চা চাষ শুরু করেন। দার্জিলিং সম্পর্কে ১৮৫২ সালে মি. জ্যাকসন তার রিপোর্টে লেখেন, ‘আমি বেশকিছু মাত্রায় ও পর্যায়ের চাষ লক্ষ করেছি। এর মধ্যে চীনা ও আসাম—উভয় প্রকারের গাছের চারা ছিল। আমি দেখেছি গাছগুলো সতেজ এবং এ থেকে মাটির গুণাগুণ বোঝা যায়।’

জ্যাকসন তার রিপোর্টে ডা. ক্যাম্পবেলের বাগানের পাশাপাশি সিভিল সার্জন ডা. উইথকম্ব ও লেবংয়ে মেজর ক্রোমেলিনের বাগানের কথাও উল্লেখ করেছেন। সব জায়গায়ই ভালো ফলাফল দেখা গিয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে শুরুর দিকের এ বাগানগুলো নিরীক্ষামূলক কাজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৮৫৬ সাল থেকে চা শিল্প উন্নত হওয়া শুরু করে। এক্ষেত্রে নিম্নভূমিতে চাষ শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যে চা শিল্প এতটা এগিয়ে যায় যে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা হয়।

ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চা চাষ শুরু হওয়ার ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৪০টি বাগান তৈরি হয়। ১৮৩৯ সালের হিসাব অনুসারে বাগান ছিল ৩৯টি, যা কিনা ১০ হাজার একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখান থেকে বছরে ৪ লাখ ৩৩ হাজার পাউন্ড চা উৎপাদন হতো। ১৮৭০ সালে মোট ১১ হাজার একর জমিতে চাষ হতো এবং উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ পাউন্ড। এ সময় চা বাগানে প্রায় আট হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। ১৮৭৪ সাল নাগাদ বাগানের সংখ্যা বেড়ে হয় ১১৩। এ সময় ১৮ হাজার ৮৮৮ একর জমিতে চা চাষ হতো এবং উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৯ লাখ ২৮ হাজার পাউন্ড। শ্রমিক হিসেবে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ কর্মরত ছিল। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ১৮৬৬-৭৪ সময়ের মধ্যে চা চাষে জমির পরিমাণ বেড়েছে ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে চা উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ১০ গুণ। সূচনা থেকে ৩০ বছর পূর্ণ করে চা চাষের জমির পরিমাণ হয় ৫০ হাজার ৬০০ একর (৭৯ বর্গমাইল)। এটি ১৯০৫ সালের হিসাব।

১৮৯৪ সালে তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি সেখানকার চা বাগানের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে তার লেখায় এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি লেখেন—

‘২৮শে জুন বৃহস্পতিবার—বেড়াইতে গিয়া চা-ক্ষেত্র বিশেষ করিয়া দেখিলাম। চা-ক্ষেত্র গুলি দেখিলে বোধ হয়, পর্ব্বত-গাত্রে কে যেন হরিত্বর্ণের মনোহর গালিচা বিস্তার করিয়া রাখিয়াছে। চা-আবাদ দ্বারা এ জেলার বিশেষ উপকার হইয়াছে; অনেক হিংস্র জন্তুর আবাসভূমি রমণীয় চা-ক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। পার্ব্বত্য বিভাগে যথেষ্ট চা জন্মিয়া থাকে। ১৮৫৩ সালে গবর্ণমেন্টকর্ত্তৃক চা-আবাদের চেষ্টা হয়, এবং ১৮৫৬ সাল হইতে আবাদ আরম্ভ হইয়াছে। এখন অনেকগুলি চা-বাগান দেখিতে পাওয়া যায়। বঙ্গ-দেশবাসিগণও একত্র হইয়া চা-আবাদ করিতেছেন। চা-ব্যবসায়ে বিলক্ষণ লাভ আছে। কোন কোন চা-কোম্পানি শতকরা ৩০।৪০ টাকা পর্য্যন্ত ডিভিডেন্ড দিতেছেন। দার্জ্জিলিং জেলায় ১৮৪টী চা-ক্ষেত্র আছে এবং প্রায় ১৪ লক্ষ বিঘা জমিতে চা-আবাদ হয়। ১৮৯৩ সালে এই জেলায় ১,৩২,২৭০ মণ চা প্রস্তুত হইয়াছিল।’

দার্জিলিংয়ের চাবান্ধব আবহাওয়া নিয়ে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্রতি বছর এখানে ১২৬-১৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। দার্জিলিং পাহাড়ের ঢালের কারণে এ পানি জমে থাকে না। চা গাছ পরিমাণমতো বৃষ্টিপাত লাভ করে বিকশিত হয়। এমনকি এখানকার মাটি কিছুটা বেলে। ফলে পানি ধরে রাখে না। ঠাণ্ডা ও হালকা বাতাসে কুঁড়িগুলো বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।

স্বাদ ও মানের ক্ষেত্রে দার্জিলিং চায়ের বিশেষ হয়ে ওঠার এগুলোই মূল কারণ। ঝোপ হিসেবে বেড়ে ওঠা চা গাছের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ হিসাব হলো, একটি ঝোপ থেকে বছরে মাত্র সাড়ে তিন আউন্সের মতো চা পাওয়া যায়। এ পরিমাণ চা পাতা থেকে মোটামুটি ৪০ কাপ চা তৈরি হয়। সমসাময়িক একটি হিসাব অনুসারে দার্জিলিংয়ের একেকটি চা বাগানে হেক্টরপ্রতি বছরে ৪০০ কিলোগ্রাম (৯০০ পাউন্ড) চা পাওয়া যায়। দার্জিলিংয়ের চায়ের বিশেষ হয়ে ওঠার পেছনে অনেকে চা শ্রমিকদের অবদানের কথাও উল্লেখ করেন। এ অঞ্চলে চা তোলার জন্য যারা কাজ করেন, তারা এক হাতে একটি কুঁড়ি দুটি পাতা এমন করে তোলেন, যেন পাতার কোনো ক্ষতি না হয়। অন্যদিকে বহুদিনের অভিজ্ঞতায় চায়ের সেরা পাতা ও কুঁড়ি চিনতে তাদের ভুল হয় না।

বর্তমানে দার্জিলিংয়ে ৮৭টি চা বাগান রয়েছে, যা প্রায় ১৯ হাজার হেক্টরজুড়ে (৪৬ হাজার ৯৫০ একর) বিস্তৃত। এসব বাগানে মোট ৫০ হাজার স্থায়ী কর্মচারী রয়েছে, যাদের ওপর প্রায় দুই লাখ মানুষের জীবন নির্ভরশীল। মার্চ-নভেম্বরে চা তোলার সময় আরো ১৫ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। বাগানগুলো থেকে উৎপাদিত চায়ের মোট পরিমাণ প্রায় এক কোটি কিলোগ্রাম। ৮৭টি বাগানের আহরিত পাতা থেকে ৭২টি কারখানা চা তৈরি করে। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত টি এস্টেটগুলোর মধ্যে আম্বুটিয়া, এভনগ্রোভ, লেবং মিনারেল, মেরিবং, ঋষিহাট, অরেঞ্জ ভ্যালি ইত্যাদি স্বনামখ্যাত।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button