বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সুর সত্ত্বেও দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে। দুই দেশের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সংযোগ এখন ১২ বিলিয়ন (১ হাজার ২০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এ মুহূর্তে একক গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) উৎস হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে। রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবেও দেশটির অবস্থান দ্বিতীয়। গত পাঁচ বছরে দুই দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণে।
রফতানি, এফডিআই ও রেমিট্যান্স বিবেচনায় দেশের অর্থনীতিতে সফটপাওয়ার (বাণিজ্যিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা) সবচেয়ে বেশি এখন যুক্তরাষ্ট্রেরই। ২০১৬ সালেও বাংলাদেশ থেকে ৫৯১ কোটি ১ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউএস সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৩০ কোটি ৩৬ লাখ ডলারে। এ হিসেবে পাঁচ বছরে দেশটির বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে ৪০ শতাংশেরও বেশি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই (জানুয়ারি-মার্চ) দেশটির বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।
বাংলাদেশে এফডিআইয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এখন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সাল শেষে দেশের মোট এফডিআইয়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান ছিল ২০ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা এফডিআইয়ের স্টকের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৩২ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগগুলো এসেছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, ব্যাংক ও বীমা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। দেশের মোট গ্যাস চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পূরণ করছে মার্কিন জায়ান্ট শেভরন। নিজেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে দাবি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে সৌদি আরবের পরই এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্থান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন (প্রায় ৩৫০ কোটি) ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেও (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে মোট রেমিট্যান্সের ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অর্থবছর বিবেচনায় গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি বেড়েছে ৫২ শতাংশের বেশি। দেশটিতে মূলত তৈরি পোশাকই রফতানি হয় সবচেয়ে বেশি। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরালো হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে চীনকেন্দ্রিক ভূরাজনীতির কথা বলছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র আমদানি বাণিজ্যে চীননির্ভরতা কমাতে চায়। এজন্য পণ্য আমদানির উৎস হিসেবে অন্যতম সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশকেই বিবেচনা করছে দেশটি। অতীতে আফ্রিকার দেশগুলো বা ভিয়েতনামে এ ধরনের বিকল্প তৈরির চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীন ইস্যুতে ওইসব দেশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে ওয়াশিংটন। বাকি দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই এখন তুলনামূলক বেশি সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন দেশটির বাণিজ্য খাতসংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে পোশাক রফতানি করছে রাইজিং গ্রুপ। নিজ উৎপাদিত পণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ মার্কিন বাজারে রফতানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পোশাকপণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, গত পাঁচ বছরে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের বড় দিক ছিল সংলাপ। সম্পর্কোন্নয়নের জন্য যে সংলাপ হওয়া প্রয়োজন তা এখন হচ্ছে। যেমন দেশটি বাংলাদেশে তুলা রফতানির ক্ষেত্রে যেসব বাধার সম্মুখীন হয়, সেসব বাধা তুলে নিতে বলছে। এর বিপরীতে আমরা বলছি, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা থেকে তৈরি সুতা-কাপড়ের পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হলে শুল্ক সুবিধা নিশ্চিত হতে হবে। সামগ্রিকভাবে দুই দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রটি অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা বাড়লেও এখনো এ-সংক্রান্ত সম্ভাবনাগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক বাজার। দেশটিতে জিএসপির আওতায় যে বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যেত, সেটি স্থগিত রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলো জিএসপির আওতায় মার্কিন বাজারে বিভিন্ন পণ্য রফতানি বাড়াচ্ছে। পোশাকপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও এখানে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। এদিক থেকে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও ভারতও এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট বার্ষিক আমদানি ২ ট্রিলিয়ন (২ লাখ কোটি) ডলারেরও বেশি। এতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। বর্তমানে যেসব মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, সেগুলোও খুব একটা শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছে না। দেশের আইনকানুন অনেক অস্বচ্ছ। মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুনাফা। সারা এশিয়ায় মার্কিন কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণে ব্যবসা করে। সে তুলনায় বাংলাদেশে দেশটির ব্যবসা খুবই অপ্রতুল।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বড় মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ধরে রাখার পাশাপাশি নতুনগুলোকে আকৃষ্ট করতে যে পরিমাণ পদ্ধতিগত উন্নয়ন দরকার, এ বিষয়ে আমাদের আরো মনোযোগ দিতে হবে। কর জটিলতার মতো বিষয়গুলো দূর করা নিয়ে ভাবতে হবে। আর ভাবনার ক্ষেত্রগুলো আরো আগ্রাসী হতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের পদ্ধতিগুলো আরো সহজ করা দরকার। বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রগুলো আরো স্বচ্ছ হতে হবে। সব মিলিয়ে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে দেশটিকে আরো বুঝতে পারার প্রয়োজন। তাদের কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলোকে আরো ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা যোগাযোগের একটা বহুমাত্রিকতা আছে। এ বিষয়গুলো আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সব মিলিয়ে আমরা সমন্বিত ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি। তাহলে বিদ্যমান সম্পর্কের চেয়েও বহুগুণ বড় অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, পরোক্ষ অনেক ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিও এখন অনেক শক্ত। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোয় মনোযোগ দিয়েছে, যা সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়ার আভাস রয়েছে।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, রফতানি, এফডিআই এগুলো হয়তো চোখে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যমান নয় এমন ক্ষেত্রগুলোয়ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হয়েছে, যেমন নলেজ শেয়ারিং। সম্প্রতি প্রাণের সঙ্গে প্রডাকশন শেয়ারিং শুরু করেছে প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল। এটি মূলত নলেজ ও টেকনোলজি শেয়ারিং। বাংলাদেশের বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অনেক সতর্কতা বজায় রেখেছেন। ইউএসএআইডিও বাংলাদেশকে অনেক সহায়তা দেয় টেকনোলজি ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফাইজারের টিকা ভারত না পেলেও বাংলাদেশ পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইতিবাচক অনেক বিষয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতিতেও মার্কিনদের সঙ্গে অনেক ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ভূরাজনৈতিক একটি প্রেক্ষাপটও আছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে অর্থনৈতিক কূটনীতির গতি অনেক শ্লথ ছিল, যেটা এখন নেই বললেই চলে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, গত পাঁচ বছর নয়, তার চেয়েও বেশি সময় ধরে সব ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য অনেকের চক্ষুশূলও হতে হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনেই, যা মাথায় রেখে কেউ কেউ এরই মধ্যে চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে, যেন নিজের দেশের জন্য কিছু সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে প্রায় সব বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক অনেক বেড়েছে। তবে গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতির জায়গাটি অনেক শক্তিশালী হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্কটা শক্তিশালী হয়েছে মূলত অ্যাফর্ডেবল প্রাইসে পণ্য বিক্রি করতে পারি, তাই। আমাদের পণ্য সরবরাহ সঠিক সময়ে হয়। এসব কারণেই বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকেছে যুক্তরাষ্ট্র। মৌলিক বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা আছে, যা মেটাতে পারছে বাংলাদেশ। আগে দেশটি ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কিনত না। কভিডের সময় বাধ্য হয়ে পিপিই ও ওষুধ নিয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদেই তারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। এটা একটা উইন উইন সিচুয়েশন। যুক্তরাষ্ট্রেরও লাভ হচ্ছে। বাংলাদেশেরও লাভ হচ্ছে। আমরা উদার, তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো বাড়বে। দেশে গড়ে উঠতে থাকা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলেও যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করতে পারে। দেশটির উদ্যোক্তারা কারখানা স্থানান্তর করতে চাইলে আমরা তাদের স্বাগত জানাই।