জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব
২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল জলবায়ু কর্মী, বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক ম্যাট মাকার্থ এক সম্মেলনে বলেছিলেন, বিদ্যমান প্যারাডাইমের মধ্যে বিশ্ব প্রাকৃতিক ও মানবিক জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। তার এ মূল্যায়ন অধিকাংশ জলবায়ু কর্মী ও বিজ্ঞানীদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল—প্রকৃতির সঙ্গে মানবিকতার সম্ভাবনাময় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাবিষয়ক এক চুক্তিতে পৌঁছতে যারা তখন প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন।
ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (আইপিবিইএস) এক্ষেত্রে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের কাজ করে আসছিল। ওই প্রচেষ্টা ছিল বেড়ে চলা সামাজিক ও প্রতিবেশগত জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিশ্ব মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জে প্রকৃতি ও মানুষের অতীত ক্ষতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা চিহ্নিত করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের মে মাসে অবশেষে একটি আন্তঃসরকারি মূল্যায়ন প্রকাশ হয়।
ওই সময় ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল যে, জীববৈচিত্র্য শব্দটি জীবনের বিস্ময়কর সবকিছুই ধারণ করে যা আমাদের ধরিত্রীতে পাওয়া যায়। শব্দটি একই সঙ্গে প্রতিটি জীব-অনুজীব এবং তাদের প্রতিবেশের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়াকেও বোঝায়। উল্লেখ করা হয়েছিল যে, পরাগায়ন এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সেবা, যা প্রকৃতি মানবজাতিকে প্রদান করে। এটি জিন থেকে শুরু করে ওরাঙ্গুটাংয়ের মতো প্রজাতি, অন্য সব সৃষ্টি এবং তাদের সমগ্র বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশকে ধারণ করে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৯২ সালে জীবতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের ওপর জাতিসংঘের একটি কনভেনশন স্বাক্ষর হয় এবং এতেও শব্দটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে। সেখানে স্থল, সামুদ্রিক এবং অন্য জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাসহ সব উৎসের জীবন্ত প্রাণের মধ্যকার পরিবর্তনশীলতা এবং তারা যেসব প্রতিবেশগত পরিবেশে বাস করে সবকিছুকে জীববৈচিত্র্যের অংশ বলা হয়েছে।
এটিও সুস্পষ্ট করা হয়েছিল যে, জীববৈচিত্র্য আমাদের মিঠা পানি সরবরাহ, উর্বর মাটি, ওষুধ জোগানো এবং স্থিতিশীল জলবায়ু নিশ্চিতে সাহায্য করে। আরো জোরারোপ করা হয়েছিল যে, সব প্রজাতিই আন্তঃসংযুক্ত এবং প্রায় প্রত্যেকেই একে অন্যের সঙ্গে নির্ভরশীল। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এ আন্তঃসংযুক্তি চক্রাকার। ছত্রাক যেমন বনের মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, এসব উর্বর মাটি আবার গাছপালা গজাতে সাহায্য করে, কীটপতঙ্গ আবার এক গাছ থেকে অন্য গাছে পরাগ বহন করে, জীবজন্তু আবার এসব লতাগুল্ম খায় এবং সামগ্রিকভাবে বন জীবজন্তুর আবাস হিসেবে কাজ করে। অবশ্য এ শৃঙ্খলের মধ্যে কোনো একটা প্রজাতির বিলুপ্তি আমাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, যেহেতু এটা আমাদের সংযোগ দুর্বল করে দেয়, যা থেকে আমরা সবাই উপকৃত হয়।
বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ, দেশীয় ও স্থানীয় জ্ঞানের ওপর নির্ভর করা আইপিবিইএসের এ গঠনমূলক প্রচেষ্টা খুব যত্নের সঙ্গে তদারকি করা হয়। কেননা প্রত্যেকে এখন বুঝতে শুরু করেছে যে, কাঠামোর মধ্যকার নেতিবাচক বিষয় মানবিক, সামাজিক ও প্রতিবেশগত জরুরি অবস্থার হুমকি তৈরি করতে পারে, যদি প্রকৃতির বিপর্যয়-ধ্বংস অব্যাহত থাকে।
আলোচ্য আইপিবিইএস প্রতিবেদন এবং আইপিসিসি প্রতিবেদন জলবায়ু পরিবর্তন হুমকি সম্পর্কে বিশ্বকে সজাগ হওয়ার ডাক দিয়েছে। এতেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো তার প্রকৃতির কারণে পুরো বিশ্বের জন্য একটা বড় সমস্যা।
তিন বছর পর চলতি বছরের মার্চের শেষের দিকে আরো কিছু মজার পর্যবেক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন ম্যাট মাকার্থ। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ বাড়ানোর একটা স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা চলমান, যা গতি পেয়েছে ২০২১ সালে।
কভিড মহামারী থেকে বিশ্বের অর্থনীতিগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় আপাতভাবে জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে। অ্যাম্বার নামে জলবায়ু ও জ্বালানি সংগঠনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ২০২১ সালে বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বিশ্বের প্রায় ৩৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, প্রথমবারের জন্য যা বৈশ্বিক বিদ্যুতের প্রায় ৩৮ শতাংশ। বলা হচ্ছে, প্রায় ৫০টি দেশ নিজেদের চাহিদার এক-দশমাংশেরও বেশি বিদ্যুৎ এসব উৎস থেকে পাচ্ছে।
২০১৫ সাল থেকে বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের অংশ দ্বিগুণ হয়েছে, যখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। বায়ু ও সৌরবিদ্যুতে দ্রুত স্থানান্তর ঘটেছে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও ভিয়েতনামে। গত দুই বছরে ওই তিন দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে সবুজ উৎস থেকে তাদের চাহিদার এক-দশমাংশ বিদ্যুৎ মিটিয়েছে। অ্যাম্বারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হানাহ ব্রডবেন্ট বলেছেন, ‘অধিক উত্তর অক্ষাংশের একটি দেশ নেদারল্যান্ডস বড় উদাহরণ যে কেবল সূর্য নয়, সৌরবিদ্যুতের জন্য সঠিক নীতি পরিবেশ থাকাও জরুরি। আর এটিই বড় পার্থক্য তৈরি করে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে।’ এ ধরনের বিকল্পের বৃদ্ধি ঘটেছে ডেনমার্কে এবং দেশটি বায়ু ও সূর্য থেকে তার প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৫০ শতাংশেরও বেশি পায় এখন।
ভিয়েতনামেও বিশেষ করে সোলারে চমত্কার বৃদ্ধি দেখা গেছে। দেশটিতে কেবল এক বছরেই সোলারে প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। দেশটিতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং এক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হয়েছে।
অবশ্য ২০২১ সালে কয়লা ব্যবহারে পুনরুত্থান দেখা গেছে। গেল বছর কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ শতাংশ বেড়েছে, ১৯৮৫ সাল থেকে যা দ্রুতগতিতে বেড়েছে। কয়লা ব্যবহার অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে চীন ও ভারতের মতো এশিয়ার দেশগুলোয়। কিন্তু কয়লা ব্যবহার বৃদ্ধি গ্যাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, বিশ্বব্যাপী যা কেবল ১ শতাংশ বেড়েছে। এটা ইঙ্গিত দেয় যে, গ্যাসের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের অধিক টেকসই উৎসে পরিণত হয়েছে।
অ্যাম্বারের আরেক কর্মী ডেভ জোনস এক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন যে গত বছরে সত্যিই গ্যাসের দাম অনেক বেড়েছে, যেখানে কয়লা গ্যাসের চেয়ে সস্তা। এখন আমরা দেখছি ইউরোপ ও এশিয়ার বড় অংশে গ্যাসের দাম বাড়ছে। সেখানে গত বছরের চেয়ে গ্যাসের দাম এখন ১০ গুণ বেশি। কয়লার দামও তুলনামূলক বেড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির এ দাম বৃদ্ধি বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় ক্লিন ইলেকট্রিসিটি চাহিদা দ্বিগুণ করেছে। কারণ অর্থনীতি মৌলিকভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে।
অন্য গবেষকরা অবশ্য পর্যবেক্ষণ করেছেন, ২০২১ সালে কয়লার পুনরুত্থান সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও কানাডাসহ প্রধান অর্থনীতিগুলো আগামী ১৫ বছরের মধ্যে তাদের গ্রিড ১০০ ভাগ রিনিউয়েবল ইলেকট্রিকে উন্নীত করতে চাইছে। এ স্থানান্থর চালিত হচ্ছে চলতি শতকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়ায়ের নিচে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখার বিষয়টি মাথায় রেখে। সেটি করতে হলে বিজ্ঞানীরা বলেন যে, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে। অনেক বিশ্লেষক বলেন যে, এটা ‘ব্যাপকভাবে সম্ভব’। ইউক্রেন যুদ্ধও বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎসে বড় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যা রাশিয়ার তেল ও গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল নয়।
বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদক এবং পোশাক শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানীয় স্থানান্তরের চেষ্টা করছে। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে যে, রুফটপ সোলার প্যানেল শিল্প গ্রাহকদের জ্বালানি খরচ তাত্পর্যজনক হারে কমিয়েছে এবং তারা তাদের পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতার কৃতিত্বও বাড়াতে পেরেছে।
প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর একটা অংশ মেটাতে কারখানার ছাদে সোলার প্যানেল বসাতে বস্ত্র ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের বিপুল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এটা কার্বন নির্গমন কমাতেও সাহায্য করছে। সর্বসাম্প্রতিক তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত ৪১টি প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানার ছাদে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাসম্পন্ন সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশই পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
এটাও উল্লেখ করা যেতে পারে যে সুইডিশ বহুজাতিক পোশাকের ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশে তার তালিকাভুক্ত পোশাক উৎপাদকদের মধ্যে রুফটপ সোলার টেকনোলজির ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়টি উদ্বুদ্ধ করছে।এটা ভালো উদ্যোগ।
রাষ্ট্রায়ত্ত নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো উন্নয়ন কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) বিদ্যুতের খরচ কমিয়ে আনতে এবং টেকসই পরিবেশের জন্য গ্রিন ফ্যাক্টরি উন্নয়নে প্যানেল স্থাপনের ৮০ শতাংশ কিংবা ৩০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। বাকি ব্যয় উদ্যোক্তারা নিজেরা বহন করছেন।
ইডকলের তথ্যানুযায়ী, ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার সিস্টেম স্থাপন করতে প্রায় ৬ কোটি টাকা লাগে। সোলার সিস্টেমে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ মাত্র সাড়ে ৬ টাকা, যা গ্যাস বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশ কম। হালনাগাদ তথ্যমতে, অভ্যন্তরীণ সোলার সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের খরচ জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ থেকে প্রায় ২০ শতাংশ কম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামী বছরগুলোয় সোলার ফটোভলটেইক-ভিত্তিক (পিভি) বিদ্যুৎ প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে সস্তা হবে।
পরিবেশবাদীদের মতে, পোশাক কারখানার ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন শুধু পরিচালন ব্যয় নয়, ভবিষ্যতে সরকারের আমদানীকৃত জ্বালানির খরচ কমাতেও সাহায্য করবে। তারা এটিও উল্লেখ করেছেন, শুধু বস্ত্র ও পোশাক কারখানার অব্যবহূত ছাদে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার সিস্টেম স্থাপন করা যাবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনও ইঙ্গিত দিয়েছেন, নিট এনার্জি মিটারিং পলিসির মাধ্যমে সরকার সৌরবিদ্যুৎ আরো সাশ্রয়ী করেছে, যা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বাড়তি সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করার সুযোগ দেয়।
দেশে নেয়া এসব প্রচেষ্টা শুধু জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবে তা নয়, উপরন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতার প্রভাব ও পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবেলার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণেও সাহায্য করবে।
মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার; আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, তথ্য অধিকার ও সুশাসন বিষয়ক বিশ্লেষক