অর্থনীতিহাইলাইটস

গ্যাস কোম্পানিগুলো মিয়ানমার ছাড়ছে, বাংলাদেশে আসবে কি

 গ্যাস কোম্পানিগুলো মিয়ানমার ছাড়ছে, বাংলাদেশে আসবে কি অর্থনৈতিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে মিয়ানমার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা। সর্বশেষ চলতি মাসেই দেশটির গ্যাস খাতে কর্মরত বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের বৃহৎ কয়েকটি কোম্পানি টোটালএনার্জিস, শেভরন, রয়্যাল ডাচ শেল ও উডসাইড পেট্রোলিয়াম দেশটি থেকে বিনিয়োগ পুরোপুরি তুলে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বহুজাতিক এসব কোম্পানির মিয়ানমারের বিনিয়োগ বাংলাদেশে স্থানান্তরের বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে অফশোরে জ্বালানি অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপের তথ্য ভাগাভাগি-সংক্রান্ত জটিলতা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের ওপর সর্বশেষ ঘোষিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এ সম্ভাবনা কতটুকু কাজে লাগাতে পারবে, সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

কালই মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) ক্ষমতা দখলের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ এক বছর রীতিমতো দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন দেশটির স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। এ দুঃস্বপ্ন থেকে সহসা মুক্তির কোনো পথও দেখতে পাচ্ছেন না তারা। দেশটির অর্থনীতির প্রতিটি খাত-উপখাতের পাশাপাশি দিন দিন অবনতি ঘটছে মানবাধিকার পরিস্থিতিরও। এ অবস্থায় সেখানে ব্যবসা ধরে রাখার কোনো যৌক্তিকতাই খুঁজে পাচ্ছে না বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও কয়েক বছর আগে দেশটির প্রচুর ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন বিনিয়োগকারীরা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে মিয়ানমারকে বিবেচনা করা হচ্ছিল এশিয়ার ‘ফ্রন্টিয়ার মার্কেট’ হিসেবে। কিন্তু তাতমাদোর ক্ষমতা দখল সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। দেশটির অন্য অনেক খাতের মতো জ্বালানি খাত থেকেও বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হিড়িক তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক মহলে প্রত্যাহারকৃত এসব বিনিয়োগ স্থানান্তরের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে উচ্চারিত হতে থাকে বাংলাদেশের নাম।

মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশও ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে বিবেচিত। এখানকার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে অনেক আগে থেকেই আগ্রহ দেখিয়ে এসেছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। প্রাকৃতিক, খনিজ ও জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগরের বিপুল পরিমাণ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ এ আগ্রহ আরো অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতিকে আরো অনুকূল করে তুলেছে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি। এ অঞ্চলের আরো কয়েকটি দেশ ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হলেও সেগুলো এরই মধ্যে চীনা প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়েছে। যদিও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত বিষয়টিকে বেশ ভালোভাবেই এড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এ ভারসাম্যপূর্ণ নিরপেক্ষতাই বাংলাদেশের জন্য বড় সম্ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে।

এর মধ্যেই গত মাসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর আর্থিক বিধিনিষেধ আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ ও পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্টে দেয়া ক্ষমতাবলে এবং ২০১৭ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জারীকৃত এক নির্বাহী আদেশের (ইও-১৩৮১৮) আওতায় এ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও একই আইনের আওতায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে মিয়ানমারের ওপরও। বিষয়টিকে পশ্চিমা মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ওপর বড় আঘাত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এর ফলে জ্বালানি খাতের পশ্চিমা বহুজাতিকগুলোর বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে কিছুটা হলেও দ্বিধার অবকাশ তৈরি হয়েছে।

দেশের জ্বালানি খাত এ মুহূর্তে বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতায় কমেছে এলএনজির সরবরাহ। অন্যদিকে প্রকট হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক গ্যাসের সংকট। এর জন্য বিশেষজ্ঞরা অনেকগুলো কারণকেই দায়ী করছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো বছরের পর বছর নতুন অফশোর গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ থাকা। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের গভীর-অগভীর অংশের ব্লকগুলোয় দুই দশক ধরে কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর প্রায় এক দশক পেরোলেও অনুসন্ধান কার্যক্রমে খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও জ্বালানি খাতের পশ্চিমা বহুজাতিকগুলোর বিনিয়োগকে কাজে লাগিয়ে এরই মধ্যে অনেকগুলো নতুন অফশোর গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। এর কোনো কোনোটি উত্তোলন শুরুর পথেও বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। তবে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে আর কার্যক্রম চালাতে চাইছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। বিনিয়োগ প্রত্যাহারের মাধ্যমে সেখানকার কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, পশ্চিমা বহুজাতিকগুলোর সঙ্গে সই হওয়া চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের জ্বালানি খাত অনেক সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছিল। তবে দেশটির রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন বেশ খারাপ। এ অবস্থায় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো সেখানে বিনিয়োগ ধরে রাখতে না চাওয়াটাই স্বাভাবিক।

প্রত্যাহারকৃত বিনিয়োগ বাংলাদেশে আকর্ষণের সম্ভাবনার ওপর মার্কিন বিধিনিষেধের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি মিয়ানমার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিদেশী কোম্পানিগুলোর এখানে বিনিয়োগের পরিবেশও ভালো রয়েছে। তবে মার্কিন বিধিনিষেধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা বহুজাতিকগুলো বাংলাদেশে এখনই বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসার পরিবর্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পথ বেছে নিতে পারে।

এছাড়া তথ্য-উপাত্তের পর্যাপ্ততাকেও এখন মিয়ানমার থেকে পশ্চিমা বহুজাতিকগুলোর প্রত্যাহারকৃত বিনিয়োগ গভীর সমুদ্রে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের জন্য নিয়ে আসার পথে বড় একটি বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও খনিজ সম্পদের অবস্থান সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। এ জরিপের তথ্যই কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে অনুসন্ধানে অংশ নিতে। মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে করতে না পারায় এতদিন বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অনুসন্ধান কার্যক্রমে টেনে আনতে পারেনি বাংলাদেশ। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও নানাবিধ কারণে তা করা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি খাতের পশ্চিমা বহুজাতিকগুলো মিয়ানমার ছেড়ে চলে গেলে প্রতিবেশী হিসেবে তা আমাদের জন্য বড় সুযোগ। আমরা যদি অনুকূল কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারি, তাহলে অবশ্যই তাদের এখানে নিয়ে আসার বড় সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে অফশোরে জ্বালানি অনুসন্ধানে তাদের কাজে লাগানোর বড় সুযোগ আছে।

তিনি আরো বলেন, কিন্তু এখানে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা হলো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অভাব। যে তথ্য-উপাত্ত আমরা দীর্ঘদিন ধরে জমা করার কথা বলছি, সেটি বাদ দিয়েই এখনই বিস্তারিত যে তথ্য-উপাত্ত আছে, সেটাও যদি দিই তাহলেও ওরা আগ্রহী হতে পারে। অফশোরের যে ডাটা আমাদের কাছে আছে, সেটুকু দিয়েও আমরা তাদের আগ্রহী করতে পারি। সে ডাটা দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে আমি শুনেছি।

অনেকটা একই কথা বলছেন ভূতাত্ত্বিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমামও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের কাছে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির সময় করা জরিপের যে তথ্য আছে, শুধু সেটুকু দিয়েও এখন পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসা সম্ভব। তবে এ বিষয়ে আমাদের অনীহাও এ বিনিয়োগ আকর্ষণের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছে।

মিয়ানমার থেকে বিনিয়োগ তুলে নেয়া জ্বালানি খাতের বহুজাতিকগুলো সেই দেশে অদূরভবিষ্যতে আবারো বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে বড় ধরনের সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি তাতমাদো ক্ষমতা দখলের পর থেকে সব ক্ষেত্রেই অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে দেশটির ভাগ্য। অবাধে পতন ঘটতে থাকে অর্থনীতির। অর্থনৈতিক মরিয়া ভাব প্রকট হয়ে উঠেছে জনগণের মধ্যে। খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত দর বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও হয়ে উঠেছে লাগামহীন। আবার মারাত্মক সংকট রয়েছে নগদ মুদ্রারও। এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দেশটিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া অর্থবছরে জিডিপির সংকোচন হয়েছে ১৮ শতাংশ। দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে অর্থনীতির এত বড় ধস আগে কখনই দেখা যায়নি।

এ পরিস্থিতি থেকে কবে নাগাদ পরিত্রাণ মেলার সম্ভাবনা রয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে। বরং দেশটির আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার দুর্বিপাক দিন দিন আরো জোরালো হয়ে চেপে বসছে। সামরিক জান্তার সঙ্গে দেশটির গণতন্ত্রপন্থীদের বিরোধ দিন দিন আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যেকোনোভাবে হোক গোটা মিয়ানমারে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর সামরিক জান্তা। এজন্য ব্যাপক আকারে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে তাতমাদোর হাতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত দেড় হাজার মানুষের। দমন-পীড়ন চালাতে গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে তাতমাদো।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button