ভারতের ঝাড়খণ্ডে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে আদানি পাওয়ার লিমিটেড। জানুয়ারিতেই উৎপাদনে আসছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। চুক্তি অনুযায়ী সচল হওয়ার পর কেন্দ্রটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশে আমদানি করা হবে। প্রধানত উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লো ভোল্টেজের সমস্যা নিরসনের উদ্দেশ্য থেকে এ বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এজন্য সীমান্ত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সঞ্চালন লাইনও এরই মধ্যে নির্মাণও করা হয়েছে। অন্যদিকে আমদানীকৃত এ বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় বণ্টনের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ এখনো তেমন একটা এগোয়নি। সর্বশেষ গত মাসের শেষ দিকে প্রকল্পের একাংশের ঠিকাদার নিয়োগের চুক্তি সম্পন্ন করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। আরেক অংশেরও এখনো কাজ শুরুই হয়নি।
সঞ্চালন অবকাঠামোর দুর্বলতা থেকে যাওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলেও এখনই তা উত্তরাঞ্চলের সমস্যা নিরসন করতে পারবে না। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বিদ্যমান সঞ্চালন লাইন দিয়ে ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। তবে বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সমস্যা আদৌ নিরসন করা যাবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, আদানির বিদ্যুৎ আমদানির জন্য দেশে দুটি ডেডিকেটেড লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল সরকার। এজন্য একটি প্রকল্পের আওতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর থেকে মনকষা সীমান্ত পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন এবং বড়পুকুরিয়া থেকে বগুড়া হয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রহনপুর-মনকষা লাইনটি নির্মাণের কাজ গত অক্টোবরে শেষ করেছে পিজিসিবি। এ লাইনের মাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশে প্রবেশ করবে।
অন্যদিকে আমদানীকৃত বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলে বণ্টন ও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য গৃহীত ‘বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্পের কাজ গোড়াতেই স্থবির হয়ে পড়েছে। পিজিসিবি জানিয়েছে, ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুৎ দেশের উত্তরাঞ্চলে বণ্টনের জন্য হাইভোল্টেজ সঞ্চালন অবকাঠামো তৈরির উদ্দেশ্য থেকে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত পিজিসিবির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর সঞ্চালন লাইনের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মোটে দশমিক ৬ শতাংশ।
অনুমোদনের পর প্রকল্পের প্রথমাংশ বড়পুকুরিয়া থেকে বগুড়া পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগ করতেই সময় পেরিয়েছে আড়াই বছরের বেশি। পিজিসিবি সূত্রে জানা গিয়েছে, এ অংশ নির্মাণের জন্য টার্ন কি ঠিকাদারের কাজ পেয়েছে ভারতীয় কোম্পানি টাটা প্রজেক্টস লিমিটেড। এ নিয়ে টাটা প্রজেক্টসের সঙ্গে পিজিসিবির চুক্তি হয়েছে গত ২৫ নভেম্বর। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ৩০ মাসের মধ্যে প্রকল্পের বড়পুকুরিয়া-বগুড়া অংশের নির্মাণকাজ শেষ করবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। সে হিসেবে শুধু এ অংশ শেষ করতেই সময় লেগে যেতে পারে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
অন্যদিকে প্রকল্পের বাকি অংশ বগুড়া থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত লাইন নির্মাণের কাজও দ্রুত শুরু হবে বলে জানিয়েছে পিজিসিবি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের পরিচালক শেখ জাকিরুজ্জামান বলেন, সঞ্চালন লাইন নির্মাণে নতুন করে সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২০২৪ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এরই মধ্যে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া লাইন নির্মাণের কাজে চুক্তি করা হয়েছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমদানি শুরুর আগেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুতের সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে গ্রীষ্ম মৌসুমে এ সংকট জোরালো হয়ে ওঠে। ওই অঞ্চলে বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। আবার যেটুকু সরবরাহ হচ্ছে লো-ভোল্টেজের কারণে তা সেখানকার অর্থনৈতিক কার্যক্রমে খুব একটা প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প-কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। সঞ্চালন লাইন দুর্বলতায় প্রতিনিয়তই বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়তে হয় স্থানীয়দের। এ অবস্থায় উত্তরাঞ্চলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তা জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্য থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে বর্তমানে এ উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে হাই-ভোল্টেজ সঞ্চালনে সক্ষম বড় ধরনের কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি।
এ অবকাঠামো সংকট দূর করতেই বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর সঞ্চালন লাইনটি নির্মাণে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ৩ হাজার ৩২২ কোটি ৩৪ লাখ টাকার ওই প্রকল্পে সরকারের অর্থায়ন ১ হাজার ৪২৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা ও পিজিসিবির নিজস্ব অর্থায়ন ১৫৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এছাড়া বিদেশী ঋণ ১ হাজার ৭৪৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
দীর্ঘ সময়েও প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পিজিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন , প্রকল্পটি হাতে নেয়ার পর এর প্রস্তুতিমূলক কাজেই প্রায় এক বছর শেষ হয়ে যায়। এরপর করোনা মহামারী শুরু হলে প্রকল্পের কাজ থমকে দাঁড়ায়। মূলত প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগেই বিলম্ব হয়েছে বেশি। এছাড়া প্রকল্পের বড় একটি অংশে ভারতীয় অর্থায়ন থাকায় সেখানেও জটিলতা ছিল।
প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে, বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের মধ্যে বড় একটি অংশ রয়েছে রিভার ক্রসিং। মূলত বগুড়া থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটারের অংশের মধ্যে ৯ কিলোমিটার রিভার ক্রসিং রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় কালিয়াকৈরে দুটি ৪০০ কেভি এআইএস বে-সম্প্রসারণ ও পার্বতীপুরে দুটি ২৩০ কেভি এআইএস বে-সম্প্রসারণ কাজও বাস্তবায়নেরও কথা রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মূলত উত্তরাঞ্চলের; বিশেষত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসন করার লক্ষ্য থেকেই আদানির বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এছাড়া জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত্প্রবাহ বাড়ানোর উদ্দেশ্য থেকেও প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল। তবে বেশকিছু জটিলতার কারণে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া সঞ্চালন লাইনটি যথাসময়ে নির্মাণ করা যায়নি। সে কারণে বিদ্যমান গ্রিড লাইন দিয়ে আপাতত সরবরাহ করা হবে।
এদিকে ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বেশ দ্রুতগতিতেই এগিয়ে চলছে। নতুন বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে আদানি পাওয়ার। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটি সুপার ক্রিটিক্যাল ও আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ারের ওপর বিদ্যুৎ বিভাগের একটি প্রতিবেদন দিতে সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটিতে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, ঝাড়খন্ডে নির্মাণাধীন আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাজ এরই মধ্যে ৭৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের মধ্যে প্রথমটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে যাবে আগামী বছরের মে মাসে।