উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী হিসাব করলে বাংলাদেশে জনবসতি গড়ে উঠেছিল প্রায় চার হাজার বছর আগে। এরপর সময়ের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, নতুন নতুন শাসক এ অঞ্চলের ছোট ছোট রাজ্য শাসন করেছেন। সময়ের প্রতিটি ধাপই এ ভূখণ্ডে রেখে গেছে তার নানা নিদর্শন। এর মধ্যে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় ৫১৮টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রয়েছে। এর মধ্যে গত দুই দশকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে ১৭৮টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে। তবে গেজেটভুক্ত করার পর জনবল সংকটসহ নানা কারণে এগুলো আর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ফলে হাতে গোনা যে কয়টি নিদর্শন এখনো টিকে আছে, সেগুলোও নষ্ট হওয়ার পথে।
সাধারণত যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে প্রাচীন এসব স্থাপনা ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। তাছাড়া এসব ধ্বংসের আরেকটি বড় কারণ হলো দখল হয়ে যাওয়া। সরকারের নির্দিষ্ট অধিদপ্তরের যথাযথ তদারকি না থাকায় বহু স্থাপনা ও স্থাপনার ভূমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি দখলমুক্ত করা হলেও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে পানাম নগরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সুবর্ণগ্রামকে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন। এ সুবর্ণগ্রামই বর্তমানের সোনারগাঁ। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন তৈরি ও কেনাবেচার প্রসিদ্ধ বাজার ছিল সোনারগাঁর পানাম নগরে। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের করা বিশ্বের ১০০ ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকায় স্থান হয় পানাম নগরের। সে বছরই গেজেট জারির মাধ্যমে পানাম নগর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন করে দেয়া হয়। যথেষ্ট তদারকি থাকার পরও ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটির ১২ একর জমি দখলের চেষ্টা করে দখলদাররা। দায়ের করা হয় ছয় ছয়টি মামলা। একই অবস্থা ঢাকার আরেক নিদর্শন লালবাগ কেল্লারও। এর ভেতরের দশমিক ১২ একর ভূমিও দখল হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনগুলো দখল করে নেয়ার চেষ্টা চলে প্রতিনিয়ত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, যথেষ্ট লোকবল না থাকায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব নিদর্শনের সর্বোচ্চ দেখভাল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
অধিদপ্তরের তথ্য কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন বণিক বার্তাকে লিখিতভাবে জানান, সর্বশেষ ২০ বছরে যে ১৭৮টি স্থাপনাকে গেজেটভুক্ত করা হয়, তার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২১টি, খুলনা বিভাগে ৪৪, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২৫ এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ৬৭টি নিদর্শন রয়েছে। বাকি নিদর্শনগুলোর অবস্থানও দেশের বিভিন্ন স্থানে।
সংস্থাটির বিভাগ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেছেন, দেশের অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দখল ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত জনবল না থাকাকেই এর কারণ বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চল পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, গত দুই দশকে এ অঞ্চলে ৪৪টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গেজেটভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে লোকবল না থাকায় অনেক নিদর্শনই নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রার ধোপখোলা মসজিদটি ভেঙে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যশোরের ঝিকরগাছার কয়েম খোলা মসজিদটি ভেঙে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ঝিনাইদহের পঞ্চরত্ন মন্দিরটিও সংস্কার করে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাগুরার শ্রীপুরে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের স্মৃতিবিজড়িত ভবনটি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় বলেন, লালবাগ, পানাম নগর, হাজীগঞ্জ দুর্গ, রাজাশন ঢিবিসহ বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে দখলমুক্ত করা হয়েছে। এসব নিদর্শন দখলমুক্ত রাখতে বা সবসময় তদারকি করতে যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন তা অধিদপ্তরের কাছে নেই। ফলে চাইলেও সবসময় অনেক উদ্যোগ নেয়া যায় না।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এদেশের মানুষ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পত্তির গুরুত্ব বোঝে না। আবার এসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সে বরাদ্দও আমরা পাই না। এমনও নিদর্শন আছে, যেখানে বছরের পর বছর আমাদের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যেতে পারেন না। গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, এরপর আর কখনই পরিদর্শনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, এমন উদাহরণও আছে প্রচুর। ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পরও বেশির ভাগ সময় তাদের কিছু করার থাকে না। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট বাড়ানোসহ যথাযথ উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
এসব বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনাওয়াজ বলেন, সত্যিকার অর্থেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। কারণ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণে বরাদ্দ কম থাকে। এত অল্প বাজেটে এত কম জনবল দিয়ে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংরক্ষণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
দেশের মানুষের মাঝে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন এ প্রত্নতাত্ত্বিক। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ অসচেতন বলেই তারা এসব পুরাকীর্তি দখল করতে চায়। কেবল সাধারণ মানুষই নয়, সরকারের উচ্চ পর্যায়েও এ সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন মানুষের সংখ্যা কম। সে কারণেই কেবল অল্প জনবলের একটি অধিদপ্তরের পক্ষে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন নিদর্শনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।