দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা যাত্রা করে ২০১৪ সালে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে চালু হয়েছিল সেবাটি। শহর নয়, আর্থিক সেবাটির বিস্তৃতিতে প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর। গত সাত বছরে সেবাটির বিস্তৃতিতে বেশ সফলতাও এসেছে। তবে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোয় সেবাটির ভূমিকা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবর্তে যেখানে ব্যবসা ও অর্থের প্রবাহ বেশি, সেখানেই খোলা হচ্ছে এজেন্ট আউটলেট। মানা হচ্ছে না আর্থিক সেবাটির আউটলেটগুলোর মধ্যকার দূরত্ব-সংক্রান্ত রীতিনীতিও। ব্যাংকগুলো আর্থিক সক্ষমতায় এগিয়ে থাকা বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে কোনো বাছবিচার না করেই। দারিদ্র্যপ্রবণ ও দুর্গম এলাকাগুলোয় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না এজেন্ট। খোলা হচ্ছে না এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই খোলা হয়েছে ৬১০টি এজেন্ট আউটলেট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় চালু আউটলেটের সংখ্যা ৯৩। ঢাকা জেলায় সব মিলিয়ে আউটলেট রয়েছে ৯৭৭টি। চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে ৬৫০টি। অথচ দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা কুড়িগ্রাম জেলায় এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে মাত্র ২২৪টি। লালমনিরহাটে এ সংখ্যা ১২৪। নীলফামারীতে ১৮৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯১ ও পঞ্চগড়ে ১৩৯টি আউটলেট চালু হয়েছে।
একই পরিস্থিতি সিলেট বিভাগের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ ও পিছিয়ে পড়া জেলা সুনামগঞ্জেও। হাওর-বাঁওড়সমৃদ্ধ জেলাটিতে এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে মাত্র ২১৭টি। অথচ শুধু কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়ই বিভিন্ন ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ১০৪টি। ফেনী সদর উপজেলায় চালু হওয়া আউটলেটের সংখ্যাও এরই মধ্যে শতাধিক ছাড়িয়েছে।
দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৬৬ শতাংশ ও ঋণের ৭৯ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলায় সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ব্যাংক শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ব্যাংকঋণের ৬৩ শতাংশ। শুধু মতিঝিল ও গুলশান থানার ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে মোট ঋণের ৪৫ শতাংশ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিটি থানায় বিভিন্ন ব্যাংকের প্রচুর শাখা রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো থানা এলাকায় একই ব্যাংকের একাধিক শাখাও দেখা যায়। এর পরও খোদ রাজধানীতে ৬১০টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট চালুর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে খাতটির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হলেও ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে পুরোপুরি ব্যবসায়িক মানসিকতা থেকে। যেসব এলাকায় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বেশি, ব্যাংকগুলো সেখানেই এজেন্ট দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। গ্রামাঞ্চলে বড় বাজারগুলোয় একই ভবনেই একাধিক ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট খোলা হচ্ছে। এতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আর্থিক সেবাটির সূচনা হয়েছিল, সেটি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সামাজিক দায়বদ্ধতার চেয়ে ব্যাংকগুলো মুনাফাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার সামাজিক দায়বদ্ধতাকে প্রাধান্য দেয়। আর ব্যাংক যেকোনো কর্মসূচি নেয়ার আগে মুনাফার দিকটি বেশি দেখে। এখন কোনো ব্যাংক যদি মহানগরীর মধ্যেই এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে সফল হয়, তাহলে সেটিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তবে ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক মানসিকতার কারণে যেসব এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং বিস্তৃত হওয়া দরকার, সেটি হচ্ছে না। যেসব এলাকার আর্থিক অবস্থা খারাপ, সেখানে নিয়োগ দেয়া এজেন্টরাও সফল হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো কোন এলাকায় কতটি এজেন্ট আউটলেট খুলতে পারবে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সে বিষয়ে গাইডলাইন দেয়া আছে। আশা করছি, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সেবার বিস্তৃতির মাধ্যমে দেশের সব জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার প্রচেষ্টা সফল হবে।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৪টি। আউটলেটগুলোর মাধ্যমে মোট ১ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৫৮টি হিসাব খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৯টি হিসাব নারীদের। হিসাবগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। এছাড়া এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান হলো দেশের এজেন্ট আউটলেটগুলোর মধ্যে ২ হাজার ১৯৯টি শহর এলাকায়, যা মোট আউটলেটের প্রায় ১৩ শতাংশ। বাকি ১৪ হাজার ৯৪৬টি গ্রামে। সে হিসাবে এজেন্ট আউটলেটের ৮৭ শতাংশেরও বেশি গ্রামাঞ্চলে থাকার কথা। তবে নগর অঞ্চলকেও গ্রাম হিসেবে দেখানোয় প্রান্তিক এলাকাগুলোয় এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দারা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামনের সারিতে। যদিও এ তিন জেলায় ব্যাংকগুলোর চালু করা আউটলেটের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে কম আউটলেট রয়েছে বান্দরবানে। এ জেলায় চালু করা আউটলেটের সংখ্যা ৩৬। এছাড়া খাগড়াছড়িতে ৬৯টি ও রাঙামাটিতে ৭৩টি আউটলেট চালু করেছে ব্যাংকগুলো। সিলেট বিভাগের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা জেলা সুনামগঞ্জে আউটলেট চালু হয়েছে ২১৭টি।
রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেশি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতেও এ বিভাগের জেলাগুলো পিছিয়ে। যদিও এ বিভাগের জেলাগুলোয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম আউটলেট চালু করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে লালমনিরহাটে ১২৪টি, পঞ্চগড়ে ১৩৯, নীলফামারীতে ১৮৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯১ ও কুড়িগ্রামে ২২৪টি এজেন্ট আউটলেট চালু হয়েছে। অথচ পাঁচটি পৌরসভা ও ৪৩টি ইউনিয়নের ফেনী জেলায় এজেন্ট আউটলেট খোলা হয়েছে ২৬১টি। ঢাকার পার্শ্ববর্তী দুই জেলা গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে চালু হওয়া এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬৮ ও ২২৭।
এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট সংখ্যা ও হিসাব খোলার দিক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অবস্থান তৃতীয়। যদিও এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে ব্যাংকটির অবস্থান শীর্ষে। ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, আমরা এখন উপজেলা শহরেও এজেন্ট আউটলেট চালুর অনুমোদন দিচ্ছি না। ঢাকা কিংবা অন্য কোনো জেলা শহর তো প্রশ্নই ওঠে না। শুরুর দিকে উপজেলা শহরে কিছু আউটলেট দেয়া হয়েছিল। এখন আমরা যেসব আউটলেট চালু করছি, সেগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে। এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার ৭০০টিরও বেশি আউটলেট চালু করেছে। ঢাকা শহরে আমাদের কোনো আউটলেট চোখে পড়ার কথা নয়।
এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার উত্পত্তি লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ব্যাংকিং ধারণা ছড়িয়েছে চিলি, কলম্বিয়া, পেরু ও মেক্সিকোয়। বিস্তৃত হয়েছে কেনিয়াসহ আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে। প্রতিবেশী ভারতেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশে সেবাটি চালু করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম এজেন্ট নিয়োগ দেয় ব্যাংক এশিয়া। এরপর অন্যান্য ব্যাংকও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে আউটলেট চালু ও ব্যাংক হিসাব খোলার দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে ব্যাংক এশিয়া। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষস্থানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আর এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের শীর্ষস্থান ব্র্যাক ব্যাংকের। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মধ্যে এজেন্ট নিয়োগ, নতুন নতুন আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। সেবাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গিও বেশ উদার বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।