মতামত

আসাম নিয়ে বাংলাদেশের নাক গলানো দরকার

আসাম নিয়ে বাংলাদেশের নাক গলানো দরকার
আসাম নিয়ে বাংলাদেশের নাক গলানো দরকার

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত দিল্লিতে এক সেমিনারে বলেছিলেন আসামে মুসলমানের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের মদত দিচ্ছে। এ কাজে সহায়তা করছে চীন। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে মুসলমান পাঠানোর ফলে আসাম যেখানে ৫টি জেলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এখন ৯টি জেলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।’

ভারতের সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন- কেউই করেনি। তবে ভারতের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আসামের মুসলমানদের ওপর বার বার পরিচালিত পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলা এবং তাদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার হুমকি, উসকানিতে সেনাপ্রধান থেকে রাজনৈতিক নেতা- সবাই শামিল হয়েছেন।

আসামের এনআরসি’র ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকার বলে আসছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও নরেন্দ্র মোদি তাই বলেছিলেন। কিন্তু নিজের দেশের নাগরিকদের তাদের রাজনীতিবিদরা অহরহ বাংলাদেশি বলা শুভ লক্ষণ নয়। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে; কারণ আসামে বড় ধরনের কোনো গোলযোগ হলেই মানুষের স্রোত নামবে বাংলাদেশের দিকে।

আসামে আবারও মুসলমানদের ওপর হামলা হয়েছে। এই হামলায় রাজ্যের ১৫টি মসজিদে আক্রমণ করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে খবরে এসেছে। মুসলমানদের বাড়ি এবং সম্পত্তিতে আগুন লাগানো হয়েছে। এসব ঘটনায় বিজেপি সরকার ছিল নিশ্চুপ। একজন দুষ্কৃতকারীকেও গ্রেফতার করা হয়নি। ভারতের প্রগতিশীল মানুষরা এ হামলার নিন্দা করেছেন। তবে সিংহভাগ মিডিয়া ছিল চুপ। তারা ব্যস্ত ছিল শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খানের ড্রাগ মামলা নিয়ে, সেটিও এখন দেখা যাচ্ছে বিজেপি সরকারের মুসলিমবিরোধী আরেকটি নোংরা খেলা।

ত্রিপুরার এবারের মুসলিম হামলার অজুহাত ছিল- বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, তাই। অথচ ত্রিপুরায় মসজিদের ওপর এ ধরনের হামলা ২০২০ সালের মার্চ মাসে হয়েছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে হয়েছে, সব সময় হচ্ছে। ত্রিপুরার দেখা দেখি মসজিদে হামলা এবং শুক্রবার নামাজ পড়ায় বাধাদানের ঘটনা ভারতের আরও কয়েকটি প্রদেশে ঘটছে। সেখানে অবশ্য কোথাও কোথাও বাধাদানকারীদের পুলিশ গ্রেফতারও করেছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাও নতুন নয়। কিন্তু সবাই জানে এসব হামলা কখনও সরকার কর্তৃক স্পন্সর করা নয়, দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা সংগঠিত এবং সরকার যথাযথ না হলেও ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে দেরি করে না। এবারের হামলায় যেসব লোক মারা গেছে তার সিংহভাগ মুসলমান, তা থেকেও বোঝা যায় সরকার সক্রিয় ছিল কিনা।

মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ থেকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মারা গেছে ৯ জন। এর মধ্যে ছয়জন মুসলিম ও তিনজন হিন্দু সম্প্রদায়ের। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। পুলিশের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সংঘটিত এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৭২টি মামলা হয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া আরও মামলা রুজু প্রক্রিয়াধীন এবং দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দমনে সরকারের দায়কে আমি কখনও ছোট করে দেখি না। দেখার অবকাশও নেই। এবারের দূর্গাপূজায় হিন্দুধর্মাবলম্বীসহ পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনে অবহেলারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু দুই দেশের সরকারের অ্যাকশনে এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ সরকার আন্তরিক ছিল, যাতে এজাতীয় ঘটনা না ঘটে আর ভারতের বিজেপি সরকার নির্লিপ্ত ছিল সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায়।

আসাম ছিল চিফ কমিশনারশাসিত প্রদেশ। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বড়লাট তখন তিনি আসাম ও পূর্ববাংলাকে একত্রিত করে গভর্নরশাসিত পূর্ণাঙ্গ প্রদেশের মর্যাদা দিয়ে পৃথক একটা প্রদেশ গঠন করেছিলেন। তখন লাখ লাখ বাঙালিকে আসামে নিয়েছিল আবাবি এলাকা সৃষ্টির জন্য। তারা এলাকা আবাদও করেছে আর বসতিও গড়ে তুলেছিল।

তারও আগে ১৮৮৭ সালে যখন ব্রিটিশরা আসামকে পৃথক প্রদেশ ঘোষণা করতে ইচ্ছা করলো তখন যে অংকের রাজস্ব আদায় হলে একটা প্রদেশ স্বতন্ত্র প্রদেশ হওয়ার মর্যাদা পায় সে পরিমাণ রাজস্ব আসামে আদায় হতো না। তখন ব্রিটিশ সরকার সিলেট, গোয়ালপাড়া ও কাচাঢ়- বাংলার এ তিনজেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে ঘাটতি রাজস্ব উদ্বৃত্ত রাজস্বে পরিণত করেছিল। তখন এই তিন জেলার লাখ লাখ বাঙালি মুসলমান আসামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল।

অসমিয়রা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির সময় থেকে সতর্ক ছিল যেন বাঙালিরা আসামে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়। ১৯৪৭ সালের সিলেটে গণভোটের সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী বারদুলই আর কংগ্রেস নেতা বিষ্ণুরাম নানাভাবে সাহায্য করেছিল যেন গণভোটে পাকিস্তান জিতে যায় আর সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। না হয় আসামে বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়- এই ছিল তাদের ভয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে আসামে বা ভারতে কোনো মুসলমান যায়নি। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিছু মানুষ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় গেছে এবং সেখানে বসতি গড়েছে- এটা সত্য।

আসামে নাগরিক গণনার নামে মুসলমানদের বার বার হয়রানি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাদপড়া মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠানো হবে; তবে হিন্দুদের আসামে থাকতে দেওয়া হবে। আসাম সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে আসামে বসতি স্থাপন করেছিল তারা সবাই অসমিয়া হিসেবে গণ্য হবে। এখন যখন সর্বশেষ গণনায় দেখছেন তালিকা থেকে বাদপড়া নাগরিকত্বহীন ১৯ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৬ লাখ মুসলমান, তখন পুনরায় নাগরিকপঞ্জি করার দাবি তুলেছেন তারা। প্রথম নাগরিকপঞ্জি হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। এখন সুপ্রিম কোর্ট বলছে, আর কোনো নাগরিকপঞ্জির প্রয়োজন নেই।

১৯৮৩ সালে আসামে ‘বাঙাল খেদাও’র দাঙ্গায় দুই হাজার মুসলমান মরেছে। গুজরাটের দাঙ্গায়ও দুই হাজার মুসলমান মরেছিল। আসাম থেকে এখন তাদের কখনও অবাঙালি, কখনও মুসলিম- এসব বলে খেদানোর চিন্তায় আছে আসামের হিন্দু মৌলবাদী সরকার। বিজেপিশাসিত রাজ্যে মুসলমান হচ্ছে ঘরে রাখা মুরগির মতো, যখন ইচ্ছে তখন জবেহ করা যায়।

আসামের এনআরসির ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকার বলে আসছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও নরেন্দ্র মোদি তাই বলেছিলেন। কিন্তু নিজের দেশের নাগরিকদের তাদের রাজনীতিবিদরা অহরহ বাংলাদেশি বলা শুভ লক্ষণ নয়। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে; কারণ আসামে বড় ধরনের কোনো গোলযোগ হলেই মানুষের স্রোত নামবে বাংলাদেশের দিকে। জাত্যাভিমানের কথা তুলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানো বিজেপি সরকারের পক্ষে নতুন কিছু নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com

এমন আরো সংবাদ

Back to top button