অর্থনীতিহাইলাইটস

চট্টগ্রামে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের গ্রেফতারে আদালতের নির্দেশনা

+6520চট্টগ্রামের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের গ্রেফতারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থঋণ আদালত। আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান গতকাল এ নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে নগরীর শীর্ষ ঋণখেলাপিদের গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত। যদিও অভিযুক্ত ঋণখেলাপিদের বেশির ভাগই আটক হয়নি এখনো। অন্যদিকে আদালতে মামলাজটও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থঋণ আদালতের পক্ষ থেকে এ বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। অর্থঋণ আদালতের সেরেস্তাদার মোহাম্মদ মুক্তাদির মাওলা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে নয় মাসে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত থেকে ১ হাজার ৩৭৩টি ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু এসব পরোয়ানার বিপরীতে আসামিদের গ্রেফতারের হার খুবই নগণ্য। এ বিষয়ে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আদালতের পর্যবেক্ষণে এসেছে, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এ আদালত থেকে ইস্যুকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানাগুলো যথাসময়ে তামিল না হওয়ায় দায়েরকৃত মামলা যথাসময়ে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ঋণখেলাপিদের গ্রেফতার না করায় বিশেষ এ আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। তাই এ আদালত থেকে ইস্যুকৃত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন থানাগুলোয় পেন্ডিং থাকা ওয়ারেন্টগুলো তামিল নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশনা দেয়া হলো।

ব্যাংক ও আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, সারা দেশের খেলাপি ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে চট্টগ্রামের এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় একাধিক শিল্প গ্রুপের ব্যাংক থেকে নেয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মামলা করলেও একাধিক পক্ষের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে খেলাপি গ্রাহকরা দিনের পর দিন ঋণ পরিশোধ না করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি মামলার দীর্ঘসূত্রতা বাড়াতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। কভিড পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর অর্থঋণ আদালত গত নয় মাসে মামলার বিপরীতে রেকর্ড পরিমাণ ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে গ্রেফতারের সংখ্যা খুবই নগণ্য।

এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের যেসব শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নূরজাহান গ্রুপ, রুবাইয়া গ্রুপ, এমইবি গ্রুপ, বাগদাদ গ্রুপ, মেসার্স হারুন ট্রেডিং, মেসার্স ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, সাইফ স্টিল রি-রোলিং মিলস, মেসার্স গোল্ডেন শিপ ব্রেকিং, মেসার্স বনলতা গার্মেন্টস ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক মামলা রয়েছে। আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। তার পরও খেলাপি এসব গ্রাহকের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

আদালতের পর্যবেক্ষণে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও অবহেলার বিষয়ও উঠে এসেছে। এতে দেখা গিয়েছে, পূবালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম সিডিএ শাখার সাজিল স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের (ইউনিট-২) বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটি থেকে খেলাপি প্রতিষ্ঠানের আসামিদের ৭ শতাংশ সরল সুদে ৮ কোটি ৭২ লাখ ১ হাজার ৯২ টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়। এ বিষয়ে আদালতে সোলেনামাও (গ্রাহকের সঙ্গে সমঝোতার দলিল) জমা দেয়া হয়। সুদ মওকুফপূর্বক ঋণ পরিশোধের সোলেনামা সন্তোষজনক না হওয়ায় সেটি নামঞ্জুর করেছেন আদালত। এ বিষয়ে আদালতের আদেশের কপি পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে আদালত বলছেন, অর্থঋণ আদালত আইনের ৩৮ ধারা ও ৪৫ ধারায় ডিক্রীকৃত টাকা পরিশোধ করে আপস-মীমাংসার সুযোগ রাখা হলেও ৪৫ (২) ধারায় আইনে তা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবলোপনকৃত ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬/২/২০১৯ বিআরপিডি সার্কুলার নং-১ অনুযায়ী অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থঋণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এ সোলেনামায় অর্থঋণ আইনের বিধান লঙ্ঘন হয়েছে। আইনের ৪৯ (২) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ব্যাংক ডিক্রীকৃত টাকা তিন বছরে ১২টি সমকিস্তিতে পরিশোধের জন্য সম্মত হতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থঋণ আইনের ৪২ (২) ধারায় নির্ধারিত সময়সীমার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে সাত বছরে ২৮টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের বিষয়ে ব্যাংক ও খেলাপি গ্রাহকের আপস-মীমাংসা হয়েছে।

পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, আসামি ২০১১ সালেই ন্যূনতম ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির অধিকারী ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছরেও তারা ব্যাংকের টাকা পরিশোধের কোনো ইচ্ছা প্রদর্শন করেনি। বিষয়টিকে আদালতের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আদালত বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর এমন নমনীয়তা ও উদাসীনতা ব্যাংক খাতকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন আদালত।

এ পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংক সিডিএ করপোরেট শাখার ডিজিএম জহিরুল ইসলাম  বলেন, আদালত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সাজিল স্টিলের বিষয়ে আদালত কী পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সে বিষয়টি নিয়ে আমি অবগত নই। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব।

তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও পুলিশ তাদের ধরতে পারে না। কেউ পুলিশের হাতে আটক হলেও পরবর্তী সময়ে জামিন নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। এ কারণে চট্টগ্রামের শীর্ষ খেলাপিদের ঋণের টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলো বার বার ব্যর্থ হচ্ছে।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button