অর্থনীতিহাইলাইটস

দেশের অগ্রযাত্রার সারথি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন

96698দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। শুরুতেই এর বহরে সংযোজিত হয় বাংলার দূত ও বাংলার সম্পদ নামের দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ। এখন পর্যন্ত বিএসসির সংগৃহীত জাহাজের সংখ্যা ৪৪টি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এর বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। স্ক্র্যাপ করা হয়েছে মোট ৩৬টি জাহাজ। বর্তমানে আটটি জাহাজের মিশ্র বহর নিয়ে বিএসসি সমুদ্রপথে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পতাকা বহন করছে। তবে সম্প্রতি ২৬টি নতুন জাহাজ বহরে যুক্ত করতে একাধিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নৌ-পরিবহন খাতের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে চায় সংস্থাটি।

মূলত যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের মধ্যে খাদ্যশস্য, জ্বালানি, ভোজ্যতেল, পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চা, চামড়া, রাসায়নিক দ্রব্যসহ কনটেইনারজাত বিভিন্ন মালামাল আমদানি ও রফতানির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এ রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। এরপর বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বহির্বিশ্বে বাংলাদেশী পতাকার জাহাজ পরিচালনা করেছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি ও অভ্যন্তরীণ পরিবহন, সরকারি সার কারখানার কাঁচামাল ও সার আমদানি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি আমদানি, সরকারি খাদ্যশস্য আমদানিসহ বেসরকারি পর্যায়ে বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলোর পণ্য আমদানিতে দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিল বিএসসি। সর্বশেষ গত এক দশকে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও সম্প্রতি নতুন করে কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে শুরু করেছে তারা।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও নিরীক্ষা) মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালেই বিএসসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় বিএসসিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিএসসি মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত। বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে আসছে। করোনাকালে সরকারি পরিবহন খাতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাভের ধারায় ছিল। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিএসসির বহরে আরো ছয়টি জাহাজ যুক্ত হবে। জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিএসসি দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিএসসি প্রধানত সরকারি কাজের কিংবা প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহনকে প্রাধান্য দেয় উল্লেখ করেন এ মহাব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বিএসসির জাহাজেও পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য পরিবহনের সময় হ্রাস ছাড়াও অর্থ সাশ্রয় হবে, যা দিনশেষে দেশের অর্থনীতিকেই আরো বেশি গতিশীল করবে।

জানা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বিএসসি ১২ লাখ টন ক্রুড অয়েল পরিবহনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিএসসির নিজস্ব লাইটারেজ ট্যাংকার দিয়ে এসব ক্রুড অয়েল লাইটারেজকরণ করবে ২৬৪ ঘণ্টা (প্রতি এক লাখ টন ক্রুড অয়েল নির্ধারিত সময়ে লাইটারেজকরণ)। বিএডিসির সার পরিবহন করবে দুই লাখ টন ও বিএসসির নিজস্ব তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ারের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করবে সাত লাখ টন। বর্তমানে সংস্থাটির সম্পদের পরিমাণ ২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিচালন আয় হয়েছে ২৭৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫১ শতাংশ বেশি।

প্রতিষ্ঠার প্রায় পাঁচ বছর পরই দেশের পুঁঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বিএসসি। এরপর ২০১১ সালে আরপিওর মাধ্যমে পুঁঁজিবাজার থেকে শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে তারা। আরপিওর মাধ্যমে সংস্থাটি ৬২ লাখ ৭৪ হাজার শেয়ার ছেড়ে ৩১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০০ টাকার সঙ্গে ৪০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মোট ৫০০ টাকা নেয়া হয়। এর মধ্যে ২৪৫ কোটি টাকা নেয়া হয় কৌশলগত অংশীদারদের কাছ থেকে। বর্তমানে বিএসসির ১৫ কোটি ২৫ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৭ দশমিক ৯ কোটি শেয়ার সরকারের হাতে, ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ৩ কোটি ৭১ লাখ শেয়ার ইনস্টিটিউটের হাতে এবং ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বা ৩ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।

বর্তমানে এমটি বাংলার জ্যোতি, এমটি বাংলার সৌরভ, এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার সমৃদ্ধি, এমভি বাংলার অর্জন, এমটি বাংলার অগ্রগতি, এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা, এমটি বাংলার অগ্রদূত জাহাজ নিয়ে চলছে বিএসসির কার্যক্রম। এসব জাহাজের মধ্যে আছে বাল্ক ক্যারিয়ার ও অয়েল ট্যাংকার। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বিএসসির বহরে যুক্ত হওয়া ছয়টি জাহাজই চীনের তৈরি। যেগুলোর প্রতিটির ধারণ ক্ষমতা ৩৯ হাজার টন। চট্টগ্রামে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও দেশে ও দেশের বাইরে সংস্থাটির কার্যালয় রয়েছে। বহির্বিশ্বে মালামাল আনা-নেয়ার সুবিধার্থে সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে দুটি আঞ্চলিক অফিস খোলা হয়েছে। বিএসসির সব জাহাজই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।

এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমদানি ও রফতানি পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে বড় ও সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য জাহাজ ও জলযোগাযোগ। বাংলাদেশে ৭১১ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র জলসীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের আমদানি ও রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ সমুদ্রপথেই পরিচালিত হয়। একটি সাগর তীরবর্তী নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব কার্গো, কনটেইনার ও ট্যাংকারের বিভিন্ন আকৃতির জাহাজের বহর থাকা অত্যাবশ্যকীয়। দেশের স্বাভাবিক ও জরুরি পরিস্থিতিতে এ ধরনের জাহাজ বহরের ভূমিকা অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বিষয়টি অনুধাবন করেই সেই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্থাটি সফলভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

আন্তর্জাতিক সব ধরনের আইন মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করে বিএসসি। এর জাহাজগুলোতে ইন্টারন্যাশনাল সেফটি ম্যানেজমেন্ট কোড ও ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি কোড চালু রয়েছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি অর্থাৎ জার্মানিশেয়ার লয়েডের সনদও সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে প্রতিটি জাহাজে একটি লং রেঞ্জ আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যেকোনো নতুন আন্তর্জাতিক আইন বা ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন করে বিএসসি।

বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য নৌ-পথের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। জনসংখ্যা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আমদানি-রফতানি বাণিজ্য প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এরই ধারাবহিকতায় নতুন নতুন নৌরুটে জাহাজ চলাচল শুরু হচ্ছে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসসি এ শিল্পের সব সম্ভাবনা কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া একটি দেশের জাতীয় পতাকাবাহী সরকারি সংস্থা হিসেবে বিএসসি প্রতিবেশী দেশসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে নৌ-বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বিশেষ সুবিধাও পেয়ে থাকে।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button