বিদেশমতামত

আফগানিস্তান: ২০ বছরের অর্জন কি বৃথা যাবে 

এই ছবিটি জার্মান ফটোগ্রাফার আনজা নিদ্রিংহাউস তোলেন।
এই ছবিটি জার্মান ফটোগ্রাফার আনজা নিদ্রিংহাউস তোলেন।

আমেরিকা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী আর খরুচে যুদ্ধ যখন একতরফা ভাবে শেষ করে নিয়ে আসছে তখন তালিবানরা ব্যাপক আগ্রাসী হয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। অনেকের কাছে মনে হতে পারে নতুন নতুন এলাকা তারা তাদের দখলে নিচ্ছে। কিন্তু আসলে ঐসব এলাকা অনেকদিন ধরেই অলিখিত ভাবে তাদের দখলে। জেলা সদরে শুধু সরকারি কিছু কর্মকর্তা থাকতেন পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে, এখন তালিবানরা নিজের হাতে সবকিছু নিতে চায়।

Kabul Photoগত বিশ বছরে কি কি অর্জন?

খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে- আমার মনেহয় গণতন্ত্র; যদিও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। তবুও  কিছু পেয়েছে আফগানরা। ভোট দিতে পারে, সামাজিক মধ্যমে অনেক কিছু বলতে পারে, সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করতে পারে। গণতন্ত্র এদের কাছে নতুন, দীর্ঘ শত বছর রাজতন্ত্র, তারপর জবরদস্তি সমাজতন্ত্র এরপর গণতন্ত্রের সাধ পেয়েছে। যদিও খুবই প্রাথমিক, তারপরও শুরু তো করেছে। এটাই এদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এদের কিছু কিছু বিষয় অবশ্য শত বছরের সংস্কৃতি, যেমন জির্গা। সবাই একসঙ্গে বসে ঐকমত্য হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। ওই পদ্ধতি যেমন রাজারা মেনে নিতো, হাল আমলের রাষ্ট্রপ্রধান বছরে অন্তত একবার জির্গা করে সিদ্ধান্ত নেয় ! জির্গা অবশ্য আইন সভার বাইরে আরেকটা সাধারণ পদ্ধতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার।
তারপর আসে উর্দু ই মিল্লি আফগান, আফগান জাতীয় সেনা বাহিনী। একেবারে ধ্বংস থেকে একটা বাহিনী তারা গড়েছে, তাদের কিছু বিশেষ বাহিনী আছে। যদিও সংখ্যায় খুবই কম, তারপরেও অত্যন্ত ক্ষিপ্র ও আক্রমণাত্মক তবে পেশাদার। তারা যখন অপহরণ বা জিম্মি উদ্ধারে কাজ করে তখন খুব কমই সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়। এরা অত্যন্ত সাহসী এবং আমি দেখেছি তাদের এই বাহিনী আমেরিকান কনভয়কেও ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রেখেছে। এদের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সন্দেহজনক কাউকে ধরলে এমন ভাবে নিয়ে যায় আশেপাশের কেউ টেরও পায়না। তবে, নির্দোষ হলে নিজ বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়। অকারণে গুম করে না।
এদের সাহস এমনই যে সামরিক দিক দিয়ে পাকিস্তানের তুলনায় নস্যি হলেও যদি একটা মৃত্যু ঘটে সীমান্তে সেটার হিসাব নিয়ে নেয়; অত্যন্ত আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন জাতি ও বাহিনী।
শিক্ষা, এখন লাখে লাখে ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়ে যায়। কিছু কিছু শহর আছে যেমন হেরাত, ওখানে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এদের এখন ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। হাজার হাজার মহিলা কাজ করে, যাদের শত শত আছেন উঁচু পদে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে ডাক্তার, প্রকৌশলী, আমলা, ক্রীড়াবিদ অসংখ্য। আমি যেখানে কাজ করি, কিছু কিছু বিভাগ আছে যেখানে মেয়ে ৭০ ভাগ। অনেক ব্যাবস্থাপক আছেন যারা দোর্দন্ড প্রতাপে কাজ করে যাচ্ছেন এবং পেশাদার ।
৯০-র ধ্বংস স্তুপ কাবুল এখন আলোকোজ্জ্বল শহর। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বাড়ন্ত শহরগুলোর একটি কাবুল। এ দেশে এখন হাজার হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা, প্রত্যেকটা শহরে উঁচু উঁচু দালান, পরিকল্পিত আধুনিক আবাসিক এলাকা।  উজ্জ্বল রাতের জীবন আর সর্বোপরি উঠতি মানুষের স্বপ্ন ।
যদিও তালিবানরা বলেছে তারা শহর ধ্বংস করবে না কিন্তু যুদ্ধ তো যুদ্ধই। কি হবে শহুরে আফগানদের প্রতিক্রিয়া? কয়েকদিন ধরে চলছে আফগান শহরগুলোর ছাদে উঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনি, আফগান সেনাবাহিনীর পক্ষে। আলো বন্ধ করে একযোগে এমনটা দেখা গেছিলো ৮০-র দশকে সমাজতন্ত্র সরকারের নিপিড়ন, হত্যা ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে! তখন ছিল সরকারি বাহিনীর বিপক্ষে আর এখন সরকারি বাহিনীর পক্ষে তালিবানের বিপক্ষে।
কেবল শুরু করেছিল পথচলা, আবারো থমকে যাবে কি? দুটি প্রজন্ম শেষ হয়ে গেছে, আবারো লোভাতুর দৃষ্টি তো আছে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার আফগান খনিজের দিকে, এখন দেখার বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত এই আফগানরা কি তাদের যৎসামান্য অর্জন রক্ষা করতে পারবে? হয়তো সময়ই সব বলবে … (চলবে)

এমন আরো সংবাদ

Back to top button