ছোটবেলার ঈদ গল্প
আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা তখন মফঃস্বলে। থানা শহর। বাসস্ট্যান্ড থেকে থানা পর্যন্ত হেরিংবোনের ইট বিছানো সড়ক। ভাঙ্গাচোড়া সেই সড়কের দুই ধারে কয়েকটি মুদি দোকান, চা-সিঙ্গাড়ার হোটেল, বাজার, তালিম হাজীর হোমিওপ্যাথি ফার্মেসি-এসব নিয়েই ছোট্ট থানা শহর। এর পাশাপাশি কিছু বসতি। বেশিরভাগই মাটির ঘড়, ছনে ছাউনি। টিনের বাড়ি ছিলো মাত্র কয়েকটা। কলেজের পশ্চিমে ধানক্ষেতের কোনায় আমাদের জুবুথুবু প্রাইমারি স্কুল। ধুলা উড়িয়ে খালিপায়ে বাসা থেকে দৌড়ে সে স্কুলে যেতো সময় লাগতো পাঁচ সাত মিনিট। রোজায় স্কুল বন্ধ থাকতো । তাই পড়ালেখার চাপ নেই। ছোট বলে রোজা রাখার চাপও কম। কিন্ত না রাখলেও সমস্যা। খাবার কই। আমরা ৫ ভাইবোন। বাবা সরকারি ব্যাংকের চাকুরে। যা বেতন পান তাতে সংসার চলে টানাহেচড়া করে। অবশ্য বেতনের সাথে রেশনও পাওয়া যেতো তখন। লাল আটা, মোটা চাল, সরিষার তেল, মশুর ডাল, চিনি এসব পাওয়া যেতো কম দামে। রেশনে ঘি-ডালডাও ছিলো কিন্ত তা আমাদের সাধ্যে কুলাতো না। অভাবের সংসারে কখনো কখনো সারাদিনে এক বেলা রান্না হতো। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে শান্ত রাখতে মা কখনো কখনো গমের আটা থেকে বের হওয়া ভুঁসির সাথে মচির পেয়াজ মিশিয়ে তেলবিহীন ‘চাপড়া’ বানিয়ে দিতেন। তাই অমৃত লাগতো তখন। এ রকম সংসারের বাবা-মা’র কাছে ঈদ কতোটা কষ্টের তা অনেকবার দেখেছি ছোটবেলায়। দেড় হাজার টাকার বেতনের সাথে আটশ’ বোনাস। তা দিয়ে মুকি দোকানের বাকি, রেশন বিল, সারা মাসের খাওয়া, স্কুল বেতন সাথে আরও কতো খরচ। ঈদে আগে তাই নতুন কাপড় কেনার খুব একটা সুযোগ তখন হয়নি। কদাচিৎ বড় ভাইয়ের পুরনো প্যান্ট অথবা রেশনে দেয়া খাকি কাপড় কেটে দুই পকেট আর ফিতাওয়ালা একটি ঝোলা প্যান্ট পেয়ছি। সাথে নীল বা লাল রংয়ের একটি স্যান্ডে গেঞ্জি। তাতেই কতো আনন্দ। পাঞ্জাবী তখনো আসেনি আমাদের পরিবারে। আব্বা সাদা টেট্রন কাপড়ের যে শার্ট পড়ে অফিস করতেন তার নানা জায়গায় সিগারেটের আগুন ছাঁই পড়ে কতো ফুটো। ঈদের আগের দিন মুঠো সাবানে তাই ধুয়ে পরিস্কার করা হতো। তিনি ওই শার্ট গায়েই ঈদের নামাজে গেছেন। মাংস নয় মা শুধু চাল-ডাল মিশিয়ে অসাধরণ স্বাদেও এক খিচুরি করতেন তখন। সাথে ফালি করে পেয়াজ কুচির সাথে পটল ভাজা। তাই আমাদের ইদের দিনের সবচেয়ে দামী খাবার ছিলো। সেমাই হতো এক দুই পদের। চৌকির ওপর গামলায় ঢাকনা দেয়া থাকতো। মাঝে মধ্যেই চুরি করে এক দুই চিমটি খেয়ে নিতাম সেখান থেকে। এভাবে খাওয়ার জন্যই বোধহয় মা তার আশেপাশে থাকতেন না।
আহারে। কি সুন্দর, কি শান্তির, কি আনন্দের দিন গেছে ।
এখন চাইলেই ঈদে দামী জামা-জুতাসহ অনেক কিছুই কেনা যায়। রোষ্ট- পোলাও, ফিরনি এসবও যখন খুশি তখন। কিন্ত এসবে সেই তৃপ্তি আর স্বাদ নেই। ফ্যাসফ্যাসে সবকিছু।
হে পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহ যারা এতো কষ্ট করে ছোটবেলায় আমাকে ঈদের সেই অমৃত খুশি দিয়েছেন সেই বাবা-মাকে তুমি কষ্ট দিওনা। রহমত বর্ষন করুন। আব্বা যেনো কবরে তার এই কষ্টের প্রতিদান পান। তাকে অনুগ্রহ করে বেহেস্ত নসিব করুন।
সবার জন্য ঈদ মুবারক।
ছোটবেলার ঈদ
আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা তখন মফঃস্বলে। থানা শহর। বাসস্ট্যান্ড থেকে থানা পর্যন্ত হেরিংবোনের ইট বিছানো সড়ক।…Posted by Karamot Ullah Biplob on Thursday, May 13, 2021