বিভিন্ন কথা বলে বাচ্চাটার কান্না থামানোর চেষ্টা করাছিলাম। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ, ওই বাচ্চাতো আমার কথাই বুঝতে পারছিলো না। শেষে আমার ব্যাগ খুজে পেলাম একটা ম্যাঙ্গো বার। দ্বিধা দন্দের মাঝেও ম্যাঙ্গো বারটি এগিয়ে দিলাম পিচ্চিটার দিকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে পিচ্চিটা বাড়িয়ে দেওয়া ম্যাঙ্গো বারটি লুফে নিয়ে কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষন ম্যাঙ্গো বারটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর হঠাৎ ম্যাঙ্গো বার ধরা হাতটি উচু করে লাফাতে থাকলো, যেন সাত রাজার ধন পেয়েছে। ছোট্ট একটা ম্যাঙ্গো বার পেয়ে খিচুরির থালা মুছে খেতে না পারার কষ্ট ভুলে গেছে পিচ্চিটা। সানগ্লাস চোখে দিয়ে চোখের জল লুকোতে হল। শেষ হবার পরও বারবার থালা মুছে খাওয়া বা ম্যাঙ্গো বার কোনটাই আমাদের কাছে বিরাট কিছু না কিন্তু এদের কাছে যে কোন উপহারই সাত রাজার ধন। সত্যি বলতে কি আমার উপহার পেয়ে কাউকেই কখনো এতো আনন্দিত হতে দেখিনি। কাইকে কিছু উপহার দিলে তার চোখে মুখে যদি আনন্দের ঝিলিক বয়ে যায়, সেটা দেখতে খুব ভালো লাগে। চোখে পানি এসে যায়। আমি জানি এই স্মৃতি অনেক দিন অনেক একলা রাতে চোখ ভিজিয়ে দেবে।
আদুপাড়া খেকে তিন্দু দের ঘন্টার পথ, ধীরে সুস্থে গেলে বড়জোর দুই ঘন্টা। তাই আমাদের তাড়া ছিলো না। আমরা পিচ্চিগুলোর সাথে আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করাছিলাম আমাদের মাঝে দোভাষি হিসেবে কাজ করছিলো পালে মুরং। সেই সংগে দেখছিলাম কিভাবে কোমর তাতে কাপড় বোনে, কিভাবে ঘরের দেয়ালের সাথে তাতের এক মাথা বেধে আর এক মাথা কোমরে বেধে দক্ষ হাতে সুতার পর সুতা সাজিয়ে যাচ্ছে। পাশেই আর এক জন দুইটা পানির পাত্রে সুতা পেচিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছিলো কোমর তাতে লাগানোর জন্য। ঘরের সামনেই গাছের নিচে একজন বাশের ঝুড়ি তৈরি করছিলো, আমি ঘুরে ঘুরে এসব দেখছিলাম।
সুর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পরতেই আমরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে ব্যাগ বোচকা পিঠে চাপিয়ে নেমে পরলাম তিন্দুর পথে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ায় ও পেটে কিছু খাবার পরায় বেশ চাঙ্গা বোধ করছিলাম। ব্যাগটা আগের চেয়ে হালকা মনে হচ্ছিলো। কিছুদুর পাহাড়ের ঢাল ধরে এগিয়ে আমরা নেমে আসলাম চাদের গাড়ির রাস্তায়। আমরা এখন পাহাড় ধরে নেমে যাচ্ছি তাই ট্রেকিংএর কষ্ট কিছুটা কম হচ্ছিলো। তার পরও রোদ থাকায় আমরা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পরছিলাম। সময় হাতে থাকায় মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছিলাম। ঘন্টাখানেক হাটার পর একটা কাজুবাদামের বাগান পেয়ে বসে গেলাম। গাছে কাজু বাদামের ফুল ধরেছে, কিছু কিছু ডগায় ছোট ছোট কাজু বাদাম ঝুলছে। আর এক দেড় মাস পরেই কাজু বাদাম পরিপক্ক হয়ে যাবে। কাজু বাদামের গোড়ায় শোভা পাবে লাল, হলুদ, কমলা রসালো মিস্টি কাজু ফল।
আর একটা পাহাড় পেরোলেই তিন্দু। পাহাড়ের উঠতেই তিন্দু বিজিবি ক্যাম্প দেখা যায়। পাহাড়ের উপর থেকে চার পাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসি। বিজিবি ক্যাম্প বামে রেখে আমরা ডানে তিন্দু বাজারের ভিতর দিয়ে সোজা চলে আসি তিন্দু নৌকা ঘাটে। ঘাটে একটা দোকানে ঢুকেই ঝাপিয়ে পরলাম বিভিন্ন খাবারের উপর। মনে হচ্ছে দীর্ঘ দিনের অভুক্ত। আমরা দীর্ঘদিন পর কোন দোকানের সামনে, আমরা চাইলেই খাদ্য কিনে খেতে পারি। এই অনুভুতিটা শুধু সেই বুঝতে পারবে যে দুর্গম পাহাড়ে খালি পেটে, তৃষ্ণার্ত বুকে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেকিং করেছে, খাবার ও পানির জন্য নির্ভর করতে হয়েছে প্রকৃতি ও নিজের সঙ্গে থাকা খাবারের। এক কেজি চিনি ও কিছু ট্যাং মিনিপ্যাক সাথে তিন জগ পানি নিয়ে হাসান ভাই বসলেন শরবত বানাতে। আমরা কলা, বিস্কুট, চানাচুর, কেক আর ব্রেড নিয়ে বসলাম।
খাওয়া শেষে এখন থানচি যাওয়ার পালা। তিন্দুতে মোবাইল নেট নাই, কিন্তু বিশেষ এক যায়গা থেকে ফোন করার ব্যবস্থা আছে। হাসান ভাই সেখান থেকে ফোন করে নৌকা আসতে বলে দিয়েছিলেন তিন্দু পৌছেই। আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করার আগেই নৌকা পৌছে গেছিলো। আমরা ব্যাগ নিয়ে উঠে পরলাম নেীকায়। হাসান ভাইএর নিজস্ব নৌকা। নৌকা চালাচ্ছেন হাসান ভাই আর লগি নিয়ে তাকে সাহায্য করছেন উছাই মারমা। এই পথে যতবার গেছি ততবারি সাঙ্গুর সৌন্দর্য বিমহিত করেছে। এবরো ব্যতিক্রম হলো না, খাড়া পাহাড়ের মাঝ দিয়ে একে বেকে বয়ে যাওয়া খরশ্রোতা সাংগুর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নৌকা। আমি দাড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা অনুভব করছিলাম। পিছন থেকে হাসান ভাই চিৎকার করে বললো রেয়ার ভাই বসেন, সামনে দেথতে পাচ্ছি না।
(এটি ক্রিস্তং, রংরাং ও ইয়াংবং ট্যুরের শেষ পর্ব। আবার নতুন কোন ট্যুরের খেরোখাতা খুলে বসবো আপনাদের সামনে। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।)