খ্যামচং পাড়ায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। আমরা হাত মুখ ধুয়ে রান্নার আয়োজন শুরু করলাম সেই সঙ্গে চলছিলো আড্ডা। ডং মুরংয়ের কাছ থেকে শুনছিলাম তাদের জীবন, জীবিকা, কৃষ্টি, কালচার, রেওয়াজ ইত্যাদি বিষয়ে। রান্না শেষ করে খেতে খেতে রাত ১২টা পার হয়ে গেলো। খাবার পেটে পরার কিছুক্ষনের মধ্যেই চাপ অনুভব করতে শুরু করলাম। আমি বললাম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হবে। হাসান ভাই জানতে চাইলো ছোটটা না বড়টা? আমি জানালাম বড়টা। জানালার কাছে এসে আঙ্গুল দিয়ে দেখলো অন্ধকারের মধ্যে। বললো ওখানে একটা লেট্রিন আছে, সাবধানে যাবেন বলে একটা হাসি দিলো।
অন্ধকারের মধ্যে যায়গাটা স্পষ্ট দেখা না গেলেও অনুমান করে নিয়ে সাবান, পানি ও টর্স নিয়ে ছুটলাম। কিছুদুর যেতেই কাঙ্খিত প্রক্ষালন কক্ষ পেয়ে গেলাম। একটা বড় গর্তের উপর দ্ইুটা বড় গাছের ডাল দিয়ে বসার মতো ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দিয়েছে, গর্তটা বেশ গভির। আমি পা রেখে বসতে না বসতেই একদল প্রানীর দৌড়ে আসার শব্দ শুনতে পেলাম, সেই সংঙ্গে ঠেলাঠেলির শব্দ ও ঘোৎ ঘোৎ শব্দ। নিজের অজান্তেই দাড়িয়ে পরেছি, নিচে টর্চ মেরে দেখি অনেকগুলো শুকর গর্তের মধ্যে ঠেলাঠেলি করছে কাঙ্খিত অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য। সবকটাই হা করে উপরে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে করে প্রক্ষালন এলাকা খেকে বের হয়ে এক দৌড়ে ডং দাদার ঘরে। সকলে হাসতেছিলো মনে হয় আমার অপেক্ষাতেই ছিলো। হাসান ভাই বললো আমি একটু আগে গেছিলাম, একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। হঠাৎ অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে নিম্নচাপ উধাও হয়ে গেলেও, অল্পক্ষনের মধ্যেই তা ফিরে এলো। আবার রওনা দিলাম এবার সঙ্গী হলো একটা লম্বা লাঠি।
সিদ্ধান্ত হলো আমরা ফিরবো আদুপাড়া হয়ে। এবার পথ দেখাবেন পালে মুরং। চৈত্রের গরম তাই রোদের হাত থেকে বাচতে ডং মুরং রাত ২ টায় হাটা শুরু করতে বললেন। আমরা সবেমাত্র শুয়েছি, পালে মুরং ডাকতে শুরু করলো। কাচা ঘুম ভেঙ্গে এতো রাতে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বের হওয়াটা সহজ ছিলো না। সব গুছিয়ে নিয়ে রাত ৩ টা নাগাদ হাটা শুরু করি কির্সতং জঙ্গল ধরে। ঘর থেকে বেরিয়েই মাথার উপর পুরো আকাশ জুড়ে আলোকিত চাঁদটা দেখে মনে হলো এই সৌন্দর্য দেখার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করা যায়। আগেও বলেছি রাতের বেলা চাদের আলোয় ট্রেকিংএর সময় অদ্ভুত একটা ভালোলাগার অনুভুতি হয় আমার। জোঁসনার আলোয় চারিদিক খুব রহস্যময় মনে হয়। অনেক দুরের কোন শব্দ হঠাত করে চমকে দেয়। হয়তো দুরে কোথাও পেঁচা ডেকে জঠেছে, মনে হবে আমাদের পাশেই কোথাও ডেকে উঠেছে পেঁচাটা। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বাদুরের পাখা ঝাপটানোর শব্দ, ঝোপের মধ্য দিয়ে কোন প্রানী চলে যাওয়ার খশখশে শব্দ বা রাত জাগা কোন পাখির ডাক সব কিছুই চমকে দেয়। ষষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে পাহাড়ের খাড়াই ধরে চাঁদের আলোয় একবার নেমে আসা, পরক্ষনেই আবার উপরে ওঠা। চাঁদের আলো, রাতের রহস্যময় পরিবেশ ও সজাক ইন্দ্রিয় ক্লান্ত হতে দেয় না। এমন রাত পাওয়া ভাগ্যের। চাদের আলো সমস্থ পাহাড়টাকে রূপের মহিমায় সাজিয়ে দিয়েছে। যতক্ষন হাটছিলাম শুধু সেই রূপ-সুধা পান করে যাচ্ছিলাম।
ভোর হতে হতে আমরা ইয়াং বং এর চুরার কাছাকাছি চলে আসি। একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছিল আর পাহাড়ের রুপ পরিবর্তন হচ্ছিল। একবার আমরা মেঘের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম আবার পরক্ষনেই মেঘ পেরিয়ে পাহাড়ের চুড়ায়। এ এক অপার্থিব সৌন্দর্য, যা বর্ণনা করা অসম্ভব। আর সূর্যদয়টা ছিল বিশেষ কিছু। মেঘের মধ্য থেকে যেনো লাল একটা থালা বেরিয়ে এলো।
সৌন্দর্য যতই মনমুগ্ধকর হোক না কেন, ট্রেকিংটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিলো না। প্রায় ছয় ঘন্টার ট্রেকিং, পথে কোন পাড়া বা ঝিরি নেই তাই সংগে থাকা পানি শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অল্প অল্প করে পানি খেতে হচ্ছিল, খেজুর ও অন্যান্য খাবার প্রায় শেষ, সাথে আছে সুধু গুর আর খিচুরি মিক্স, গুর আর একটু করে পানি খেয়ে পথ চলতে হচ্ছিলো। রাস্তায় গাছ থেকে তেতুল ও কিছু অচেনা ফল (পালে মুরং এর পরামর্শ ক্রমে) সংগ্রহ করেও খেতে হয়েছে। এই নাম না জানা অচেনা ফল আমাদের চলার শক্তি জুগিয়েছিলো। ধন্যবাদ পালে মুরং এই ফলের খোজ দেওয়ার জন্য। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ ফলটা বিষাক্ত ছিল না।
ইয়াং বং এ এসে চুড়া নির্বাচন করতে বেশ বেগ পেতে হলো। তিন চার জায়গায় জি পি এস রিডার দিয়ে মেপে শেষে মুল চুড়া পেয়ে যাই। সেখানে গাছের গুড়িতে লেখা সামিট নোটও পাই দুর্যয় গ্রুপের। মনে পরলো একটা সামিট নোট পথের মাঝে ঝুলে থাকতে দেখেছি, সকলের অনুরোধে উসাই চুড়া থেকে নেমে সামিট নোটটা নিয়ে এসে বোতলে ভরে আমাদের সামিট নোট সহ ঝুলিয়ে দিয়ে আবারও যাত্র শুরু করি আদু পারার দিকে। (চলবে)