ভ্রমণ

রাজ ধনেশের দেশ ক্রিস্তংয়ে

ভবঘুরের খেরোখাতা

25ক্রিস্তং এর দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে,  ক্রিস্তং এর বনের বুক চিরে গাইড ডং মুরং সহ হেঁটে চলছি চুড়ার দিকে। চাঁদের গাড়ির রাস্তা থেকে ট্রেকিং এর রাস্তায় ঢুকতেই আর কোন পথের চিহ্ন নেই, গভীর বন, কিছু কিছু জায়গায় সূর্যের আলোও প্রবেশ করে না। এখন আমরা বেশিরভাগ সময় উপরের দিকে উঠছি। তার পরও ব্যাগ না থাকায় ও ছায়া থাকায় ট্রেকিং করতে কষ্ট কম হচ্ছিলো। গাছ কাটা দেখতে ও ছবি তুলতে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি তাই দ্রুত পা ফেলে উঠে যাচ্ছিলাম পাহাড়ের ধার ধরে। নামার সময় নামছিলাম দৌড় দিয়ে।

যত সামনে যাচ্ছি বন তত ঘন হচ্ছে। পথের চিহ্নতো নেইই, ঘন জঙ্গলে গাছের ডাল ও লতায় পা আটকে যাচ্ছিলো। ডং দা আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে। একটা বিষয় আমাকে স্বস্থি দিচ্ছিলো যে এই দিকটাতে কাঠ চোরাকারবারীদের কালো থাবা এখনো পড়েনি। আমরা আশা করাছিলামি এদিকটায় রাজ ধনেশের দেখা মিললেও মিলতে পারে। রাজ ধনেশের বসবাস গহিন বনে। ধনেশ দারুন ভাবে স্থান কালের উপর নির্ভর করে । একটি জোড়া একই এলাকায় আজীবন থাকে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে অনেক সময় বাধ্য হয়ে বাসা বদল করে। ডং মুরং জানালো কয়েকটা ধনেশের জোড়া ক্রিস্তংয়ের চুড়ার আশপাশে এখনো আছে। কাঠ চোরাকারবারীদের থাবা বনের যতো গভিরে বিস্তৃত হচ্ছে ধনেশপাখিগুলো ততো গভিরে চলে যাচ্ছে। আমরা চুড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি আর উপরের দিকে লক্ষ্য রাখছি যদি রাজ ধনেশের দেখা পাই?

রাজ ধনেশ খুজতে যেয়ে আরা লক্ষ্যই করিনি যে, আমরা কোন একটা প্রাণীর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছি। ডং দাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো চিতা বাঘের পায়ের ছাপ এগুলো। আরো বললো বাঘটা ক্ষুধার্ত। মাঝে মাঝে পথের মধ্যে বড় বড় আঁচড়ের চিহ্ন, যেনো চিতা তার রাগ প্রকাশ করেছে। চিতাবাঘ যখন খুব ক্ষুধার্ত থাকে তখন সে এভাবেই আচর কাটে। ডং দা আমাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মনে হচ্ছে আমারা যেন চিতাবাঘটিকেই অনুসরণ করছি।

কিছু সামনে যেতেই দেখি চিতাবাঘের বিষ্ঠা। দেখে ডং দা বললো দেখুন দেখুন চিতাবাঘ পায়খানা করেছে খুব বেশি হলে এক থেকে দেড় ঘণ্টা আগে, ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন ভিতরে হরিণের লোম দেখা যাচ্ছে। অথ্যাৎ শেষবার চিতাটা একটা হরিণ শিকার করেছে। ভয়ে আমাদের আত্মা শুকিয়ে গেল। আমরা একটি ক্ষুধার্ত চিতা বাঘকে অনুসরণ  করে ক্রিস্তং এর চুড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি যে কিনা এক থেকে দেড় ঘণ্টা আগেও এই জায়গায় ছিল।

258যাই হোক উপায় নেই, আমাদের সামনে অগ্রসর হতেই হবে। সবার হাতে লাঠি থাকলেও হাসান ভাইয়ের হাতে লাঠি নেই, তাই সে লাঠি কেটে নিল, এমন ভাব লাঠি দিয়ে চিতাবাঘ কাবু করে ফেলবে। রাস্তার ঘন জঙ্গল অচেনা পথ, পথ হারানোর ভয়, সবশেষে চিতা বাঘের ভয় পেরিয়ে যখন আমরা চুড়ায় পৌঁছাই অজানা এক ভালো লাগা আমাদেরকে ছুঁয়ে গেল। প্রথমে বসলাম পূর্ববর্তী ক্রিস্তং বিজয়ীদের সামিট নোট নিয়ে। পেয়ে গেলাম ব্যাকপ্যাকার্স খ্যাত লিজেন্ড ট্রেকার জাফর ইকবাল,তানভীর হোসাইন,  নাজমুল হাসানের মতো ট্রেকারের সামিট নোট। প্রত্যেকেই সামিট নোটে তাদের সামিটের তারিখ, সময় ও দলে সদস্যদের নাম লিখে রেখেছেন। অনেকে লিখে গেছেন তাদের দীর্ঘ চলার পথে পাওয়া অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ, আনন্দ, কষ্ট, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা। লিজেন্ডদের পাশাপাশি প্রিয় কিছু  ট্রেকারদের সামিট নোটও পেলাম। তাদের মধ্য সেতু দাস ও তানিস্ক অন্যতম। বর্তমান ট্রেকারদের মাঝে সেতু দাস  একটি পরিচিত নাম। বিশেষ করে বলতেই হয় টিম দুর্জয় খ্যাত  তানিস্ক এর কথা। এই বয়সে ওরা যেভাবে বাংলাদেশের পাহাড়ের আনাচে কানাচে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অচিরেই তারা সবার দৃষ্টিতে চলে আসবে এ আমি নিশ্চিত।

এরপর আসলো আমাদের সামিট নোট লেখার পালা। আগের মতোই সামিট নোট লিখতে বসলেন কিরন ভাই। এই ফাকে আমরা সংগে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে পানি খেয়ে নিলাম। এরপর সামিট নোটগুলো আবার বোতলে ভরে ঝুলিয়ে দিলাম। ভাবতে ভাল লাগছিল যে এইসব লিজেন্ড ও প্রিয় পর্বতারোহীদের সামিট নোটের সাথে আমাদের সামিট নোটগুলোও স্থান পাবে ক্রিস্তং এর চুড়ায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। পরবর্তীতে অন্য কোন পর্বতারোহীর দল হয়তো আমাদের এই সামিট নোটগুলো বের করে বোঝার চেষ্টা করবেন নোটের পিছনে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো।

পাহাড়ের চুড়া থেকে আমাদের গাইড ডং মুরং দেখাতে থাকলো কোন পাহাড় কোন দিকে, কোন পাড়া কোন দিকে, কোন পাড়ায় কোন রাস্তায় যেতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘন ঝোপের মধ্য থেকে আশপাশের দৃশ্য ক্যমেরাবন্দী করে আমরা অতি দ্রæততার সহিত খ্যামচং পাড়ার দিকে পা বাড়ালাম। (চলবে)

এমন আরো সংবাদ

Back to top button