ভ্রমণ

রাজ ধনেশের বনে শকুনের কালো থাবা

ভবঘুরের থেরো খাতা

258গাইড ডং মুরং সহ আমরা বেরিয়ে পড়লাম ক্রিস তং এর পথে। আমাদের সকলের ভিতরেই এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল, কারণ অনেকদিন থেকেই আমরা শুনে আসছি বাংলাদেশের অন্যতম এক্সাইটিং ট্রেকিং রুট হচ্ছে ক্রিসতং। আমরা অপেক্ষা করছিলাম বেশ কিছু অজানা ভালো লাগার, নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের, নতুন কিছু দেখার। কিছুদুর এগুতেই বুঝতে পারলাম কেন ক্রিসতংকে অন্যতম এক্সাইটেড ট্রেকিং রুট বলা হয়। আমি বাংলাদেশের যতগুলো ঘন প্রাকৃতিক বন দেখেছি, কোনোটাতেই ক্রিসতং এর মতো এতো বিশাল বিশাল বৃক্ষ দেখিনি, এক একটি বৃক্ষ যে কত বছরের পুরনো তা বলা মুশকিল।

পাহাড়ের ঢালে বিশাল বিশাল বৃক্ষ, আর ঘন জঙ্গল, কিছু কিছু যায়গায় সুর্যের আলোও প্রবেশ করে না। মানুষের চলাচল নেই, কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ।আমরা হাটছিলাম আর মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। এই ঘন জঙ্গলের ভিতর এক একবার পাহাড়ের নিচে নামা, আবার পরক্ষনেই উপরে ওঠা। আমাদের এক্সাইটমেন্ট এত বেশি ছিল যে আমরা নামার সময় দৌড় দিয়ে নেমে ওই গতিতেই উপরে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। কিরণ ভাই বলছিল আপনারা কিন্তু বেশি তাড়াহুড়া করছেন, একটু ধীরেসুস্থে যাই। কিন্তু আমাদেরকে মুগ্ধতার ঘোর যেন কাটছেই না। ডং দার কাছে জানতে পারলাম এই বনে এখনো অনেক প্রাণী আছে মাঝে মাঝে চোখে পড়ে চিতা বাঘ, ভাল্লুক. হরিণ, বানর, সাপ, ময়ূর সহ আরো অনেক পশু পাখি। সবথেকে বড় কথা হচ্ছে এখানে দেখা যায় রাজ ধনেশ। রাজ ধনেশ প্রকৃতির এক অপরূপ শোভা। সৌন্দর্যের প্রতীক। এদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে লম্বা ঠোঁট। সারা দেহে সাদা-কালো ও হলুদ রংয়ের নয়নাভিরাম ছোপ। মানুষের মতোই এদের চোখের পাতার নিচে চুল রয়েছে। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম পাখিদের একটি। এর ঠোঁটের মাথা থেকে লেজের শেষ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৯৫ থেকে ১০৫ সেন্টিমিটার, অর্থাৎ এরা আকৃতিতে শকুনের চেয়েও অনেক বড়। রাজ ধনেশের বসবাস গহিন বনে। ধনেশ দারুণ ভাবে স্থান কালের উপর নির্ভর করে । একটি জোড়া একই এলাকায় আজীবন থাকে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে অনেক সময় বাধ্য হয়ে বাসা বদল করে। বাংলাদেশে এটি বিরল এবং প্রায় বিলীন পাখী। একসময় সম্ভবত সব মিশ্র চিরসবুজ বনেই রাজ ধনেশ বাস করতো। এখন বাংলাদেশে ক্রিস্তং ছাড়া  অন্য কোন বনে চোখে পরে না। বাংলাদেশ ছাড়ারাও নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় রাজ ধনেশ পাওয়া যায়।

478আমাদের ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগল না, এর জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বনের একটু ভিতরে ঢুকতেই আমরা কিছু কাটা গাছ দেখতে পেলাম। ডং দা কে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম কে বা কারা গাছ কেটে কেটে চান্দের গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে। কেওকারাডাং এর কথা মনে পরে গেল, এমনি ভাবে গাছ কাটতে কাটতে কেওকারাডাং এর বৃক্ষরাজি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আমরা যারা কেওকারাডাং ট্রেকিং করেছি, তারা দেখেছি পুরো পাহাড়ে কোন গাছ নেই একদম ন্যাড়া পাহাড়, ওই পাহাড়ও একদিন পরিপূর্ণ ছিল বড় বড় বৃক্ষে। আর কেওকারাডাং এর চান্দের গাড়ির রাস্তাও তৈরী করেছিল কাঠ চোরাকারবারীরা।

ক্রিস্তং এর গাহাড়েও কাঠ চোরাকারবারীদের অশুভ থাবা পরেছে। কান পাতলেই বিভিন্ন দিক থেকে গাছ কাটার শব্দ আসছিল। চান্দের গাড়ির পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না, এই খাড়া রাস্তা মাঝে মধ্যে কাঠের ভাঙ্গা ব্রীজ, এর মধ্য দিয়ে কাঠ বোঝাই গাড়িগুলো কিভাবে যায়, আসে সৃষ্টিকর্তাই জানে। হাসান ভাইয়ের কাছে জানা গেল গাড়ি চালাতে তিন জন ড্রাইভার লাগে।

গভীর বনে ঠুকতেই দেখলাম গাছ কাটার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। বনের নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে বেশকিছু শ্রমিক করাত, দা, কুঠার নিয়ে ঝাপিয়ে পরেছে বৃক্ষরাজির বুকে, বিরাট বিরাট বৃক্ষের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে নিপুন দক্ষতায়। একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, তারা আছে ১০ জন, মূলত এসেছে কক্সবাজার, উখিয়া, চকরিয়া এইসব অঞ্চল থেকে। সকলেই থাকে খ্যামচং বা পারাও পাড়াতে। সভাবত মনে প্রশ্ন জাগে গভীর জঙ্গলে এরা কারা, জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের কারা এখানে  পাঠিয়েছে, এইসব কাঠ যায় কোথায়? আমাদের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ওরা নিজের কাজে মন দেয়, শরীরী ভাষায় বুঝিয়ে দেয় এসব প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই বরং সমস্যা হতে পারে, আমরাও ঝামেলা এড়িয়ে হাঁটতে শুরু করি।

একসময় গাছ কাটার শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়, কিন্তু আমি আকাশে কান পাতলেই শুনতে পাই ক্রিস্তং এর কান্না। মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন, কারা এই অশুভ শক্তি, একের পর এক বন নিধন করে চলছে। কেউ কি দেখার নেই, কিছুই কি করার নেই,। এই লোভী, অমানুষ ও মহাশক্তিধর অশুরের কাছে কি আমাদের বন, আমাদের জঙ্গল, আমাদের প্রকৃতি, আমাদের জীব বৈচিত্র, আমরা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, আমাদের মানবতা জিম্মি? তাহলে পরবর্তীতে কোন একদিন ক্রিস্তং অভিযাত্রীদের কাছে গাইডরা গল্প করবে, একদা এই পাহাড়ের বুকে বিরাট বিরাট গাছ ছিল, ছিল ঘন জঙ্গল যেখানে সুর্যের আলো প্রবেশ করত না, ছিল চিতা বাঘ, হরিণ,  ভাল্লুক. অজগর সাপ, ময়ুর, বানরসহ অনেক প্রাণী। বাংলাদেশে একমাত্র এখানেই দেখা যেতো রাজ ধনেশ।

পুনশ্চঃ সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য যেরকম আন্দোলন, রোডর্মাচ, টকশো দেখি, ক্রিস্তং নিয়ে দেখিনা কেন? হয়তো গাহাড় নিয়ে বেশী কথা বলতে মানা (চলবে)

এমন আরো সংবাদ

Back to top button