
সকাল ০৭ টা ১৫, সূর্য সবেমাত্র দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে উকি দিচ্ছে, দুই ঘন্টারও বেশি সময়ের এক্সট্রিম ট্রেকিং শেষে, ভবোঘুরর দল শেষ পর্যন্ত রংরাং সামিট করলো। রংরাং এর চূড়ায় উঠে প্রত্যেকের চোখে মুখে স্বস্থির হাসি আর শারিরিক ভাষায় পাহাড় জয়ের আনন্দ খেলা করছিল। হোক না ১৮তম বা ২০তম, আরও একটি প্রায় ৩০০০ ফুট (২৭৯৫ ফুট) উচু চুড়া থেকে বাংলাদেশের আপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারায় সকলে নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছিলো। বিশেষ করে রংরাং আর ক্রিস্তং এ সামিট করার ব্যাপারটাই আলাদা। এমন ঘন বন আর পশুপাখী সমৃদ্ধ পাহাড় রংরাং আর ক্রিস্তং ছাড়া হাতে গোনা কয়েকটা আছে। আমাদের গাইড ল্যাং দা চুড়া থেকে দেখাতে থাকলেন কোন পাহাড় কোন দিকে, কোন পাড়া কোন দিকে, আমরা কোন পথে ফিরবো ইত্যাদি ইত্যাদি। উপর থেকে প্রায় ১০০০ ফুট নিচের খ্যামচং পাড়া দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ের ধার ঘেসে ছোট্ট একটা গ্রাম। পাহাড়ের এক পাশ থেকে সকালের সুর্য আলো ফেলেছে। উপর থেকে পাড়ার অর্ধেকটা অলোকিত আর বাকী অর্ধেকটা গাড় ছায়ায় আবৃত মনে হচ্ছিলো। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আলোকিত অংশে মানুষের ক্রিয়াকলাপ ও চলাচল দৃষ্টিগোচর হয় আর গাড় কালো ছায়া অপর অংশটাকে রহস্যময় করে রেখেছে। সুর্য যতো উপরে উঠছিলো গাড় ছায়ায় রহস্য ভেদ করে পুরো পাড়াটাই সমানভাবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো। কে যে কি অপরুপ লাগছিল তা এই খেরো খাতায় লিপিবদ্ধ করা আমার কম্ম নয়।

এইসব পাহাড়ের চুড়ায় উঠলেই দেখবেন সামিট পয়েন্টে বোতল ভর্তি সামিট নোট প্রথমেই আমরা বসলাম, পূর্বে যারা সামিট করেছে তাদের সামিট নোটগুলো নিয়ে। বেশকিছু পরিচিত মুখও পেয়ে গেলাম, পেয়ে গেলাম কিছু লিজেন্ড পর্বতারোহীদের সামিট নোটও। প্রত্যেকেই সামিট নোটে তাদের সামিটের তারিখ, সময় ও দলে সদস্যদের নাম লিখে রেখেছেন। অনেকে লিখে গেছেন তাদের দীর্ঘ চলার পথে পাওয়া অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ, আনন্দ, কষ্ট, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা। এখানেই খুজে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া সাত বন্ধুর রক্তমাখা সামিট নোট। যেখানে উঠে এসেছে তাদের দুঃখ, কষ্ঠ, পথ হাড়িয়ে ফেলা,দল ছুট হয়ে যাওয়া, বন্ধুকে হাড়িয়ে ফেলা,এ্যাডভেঞ্চার অনেক কিছু। শুধু এই সামিট নোটটা নিয়েই হতে পারে একটি গল্প, একটি উপন্যাস, তার গল্প আর এক দিন হবে। এইরকম অসংখ্য সামিট নোটে আমরা হাড়িয়ে যাচ্ছিলাম অসংখ্য পর্বতারোহীর দুঃশাহসিক অভিযানে। আমরা এক এক করে দেখছিলাম আর উপলদ্ধি করছিলাম সামিট নোটগুলোগুলোতে লুকিয়ে আছে কত পর্বতারোহীর ঘাম, রক্ত, তাদের প্রচেষ্টা, ভালোবাসা …….।

আমরা রংরাং এর চুড়া থেকে আসপাশের গ্রাম ও পাহাড়গুলি দেখছিলাম। যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। পাহাড়ের উপর থেকে ছবির মতো সুন্দর গ্রামগুলো দেখে ভাবছিলাম আমাদের দেশটা এতো সুন্দর!!! আর নিজের মতো করে ক্যামেরাবন্দী করে রাখার চেষ্টা করছিলাম পাখির চোখে দেখা আমাদের এই দেশটা। কিছুতেই মন ভরছে না। মনের ক্যমেরায় তোলা ছবিগুলো যে তার চেয়ে অনেক বেশী সূন্দর!!!
এখন আমাদের সামিট নোট লেখার পালা, কিরণ ভাই বসলেন সামিট নোট লিখতে। এদিকে ক্ষুধায় আমাদের যায় যায় অবস্থা, আমাদের রাধুনীরাজ হাসান ভাই রান্নার আয়োজন শুরু করলেন। আজকের মেনু স্যুপ উইথ নুডলস্। হাসান ভাই বাঁশ কেটে দ্রুততার সহিত চুলা বানিয়ে ফেললেন, সঙ্গে পাতিল তো ছিলই। আর ফাঁকিবাজ আমি বসে গেলাম ছবি আকতে।
সামিট নোট লেখা শেষে সামিট নোট গুলো যত্নসহকারে ভাজ করে বোতলের মধ্যে ঝুলিযয়ে রাখলাম। ভাবতে ভাল লাগছিল যে এইসব লিজেন্ড পর্বতারোহীদের সামিট নোটের সাথে আমাদের সামিট নোটগুলোও স্থান পাবে রংরাং এর চুড়ায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। পরবর্তীতে অন্য কোন পর্বতারোহীর দলগুলো হয়ত আমাদের এই সামিট নোটগুলো বের করে বোঝার চেষ্টা করবেন নোটের পিছনে লুকিয়ে থাকা আনন্দ, ভালোবাসা, শ্রম……
রান্না শেষ হতেই হাসান ভাই তাড়া দিচ্ছিলো তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য, আমাদের পেটেও ছুচো দৌড়াচ্ছিলো। আমরা দ্রুত খাওয়ার জন্য আসলাম। হাসান ভাই কলা পাতায় করে পরিবেশণ করলেন সুস্বাদু চিকেন কর্ন স্যুপ উইথ নুডল্স। এই ট্যুরের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার খুব তৃপ্তি সহকারে খেলাম আমরা। আমরা খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। যতই বেলা বাড়ছিল, সুর্যের তাপ ততই বাড়ছিল। আমাদের গাইড ল্যাং মুরং তাড়া দিল, চলেন তাড়াতাড়ি যাই, তাছাড়া পথে গরমে কষ্ট পাবেন। (চলবে)