অর্থনীতিহাইলাইটস

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নেই গড়ে ওঠে মিল্ক ভিটা

milk  vসনাতনী বাজার ব্যবস্থায় দুধের ন্যায্য দাম পেতেন না কৃষক। শহরের মানুষের কাছেও পণ্যটি সহজলভ্য ছিল না। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও ছিল অনেক বেশি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে এটি ছিল সাধারণ এক বাজারচিত্র। ৫০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, এ চিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দুধ হয়ে উঠেছে সহজলভ্য ও সাধারণ একটি নিত্যপণ্য। অন্যদিকে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের লাভজনক ব্যবসায় প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছেন খামার উদ্যোক্তারাও। দুগ্ধ শিল্পে ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। এ রূপান্তরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা)। দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সাফল্য তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

পত্তনের সময়ে মিল্ক ভিটার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, কৃষকের দুধের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, যাতে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। দ্বিতীয়ত, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে দেশের সবখানে দুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। অর্ধশতাব্দীর অগ্রযাত্রায় এ দুই উদ্দেশ্য পূরণের পাশাপাশি দেশের দুগ্ধ শিল্পের বাজারকে বদলে দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে মিল্ক ভিটা। দেশের তরল দুধের বাজারের ৭০ ভাগ প্রতিষ্ঠানটির দখলে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার তরল দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন করছে প্রতিষ্ঠানটি।

মিল্ক ভিটা দেশের দুগ্ধ শিল্পের চালক হয়ে ওঠে স্বাধীনতার পর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায়। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ছিল, দেশের দুগ্ধ শিল্পকে ভারতের মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশনের (জিসিএমএমএফ) আদলে গড়ে তুলবেন তিনি। ভারতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে দুধ উৎপাদনকারীদের গড়ে তোলা সমবায় প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য তাকে আলোড়িত করেছিল।

এরই আলোকে ১৯৭৩ সালে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে প্রথম স্থাপিত হয় মিল্ক ভিটার দুধ পাস্তুরীকরণ কারখানা। সমিতির মাধ্যমে দুধ সংগ্রহ করতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে মিল্ক ভিটা দেশের সাতটি বিভাগের ৩২টি জেলার ১৩২টি উপজেলা থেকে তরল দুধ সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে বিপণন করছে। দুধ সংগ্রহের পাশাপাশি খামারিদের স্বল্প সুদে ঋণ, কৃত্রিম প্রজনন সেবার অংশ হিসেবে খামারিদের বিনা মূল্যে সিমেন ও ভ্যাকসিন বিতরণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ এবং গোখাদ্য কারখানা স্থাপনসহ দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে মিল্ক ভিটা।

দেশে কারখানাভিত্তিক দুগ্ধ শিল্প গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে। ব্যক্তি উদ্যোগে সিরাজগঞ্জে ‘ন্যাশনাল নিউট্রিশন কোম্পানি’ নামে একটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় ১৯৪৬ সালে। দেশভাগের সময় এ উদ্যোগ থমকে দাঁড়ায়। পরে ১৯৪৮ সালে কারখানার মালিকানা বদল হয়। সে সময় এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইস্টার্ন মিল্ক প্রডাক্টস। এ প্রতিষ্ঠান ১৯৫২ সাল থেকে দুধ, ঘি, মাখনসহ বিভিন্ন পণ্য বাজারজাত শুরু করে। এসব পণ্য ‘মিল্ক ভিটা’ নামে বিক্রি হতো কলকাতার বাজারে। পরে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম সমবায় ব্যবস্থাপনায় আসে। সে সময় এর নাম পাল্টে রাখা হয় ইস্টার্ন মিল্ক প্রডিউসার্স কোঅপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেড। তবে এ ব্যবস্থায় কারখানার কার্যক্রম সফল হয়নি। পরে ১৯৬৮ সালে এর দায়িত্ব নেয় সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি। একই সময়ে অস্টো ডেইরি নামে বোতলজাত দুধ উৎপাদন ও বিপণনের আরেকটি প্রতিষ্ঠান সমবায় মার্কেটিং সোসাইটির কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা আর আর্থিক সহযোগিতার অভাবে দুটি কারখানাই বন্ধ হয়ে যায়। সমবায় মার্কেটিং সোসাইটির বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা দুটির দায়-দেনা পরিশোধ করে ১৯৭৩ সালে নতুন এলাকায় ‘সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প’ নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। দেশের পাঁচটি দুগ্ধ এলাকায় কারখানা স্থাপন করা হয়। ১৯৭৭ সালে প্রকল্পের নাম বদলে করা হয় বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা)।

এরপর পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠানটির আরো ৪৩টি দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানা স্থাপন করা হয়। মিল্ক ভিটার কার্যক্রম আরো বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ঢাকার কারখানায় মিল্ক ভিটা ইউএইচটি মিল্ক ভিটা প্লান্ট, বাঘাবাড়ীঘাট কারখানায় ‘মিল্ক ভিটা কনডেন্সড প্লান্ট, ‘মিল্ক ভিটা ইউএইচটি মিল্ক প্লান্ট’, ‘কনডেন্সড মিল্ক ক্যান মেকিং প্লান্ট’ ও প্রধান কার্যালয়ে ‘মিল্ক ভিটা ক্যান্ডি প্লান্ট’ ইত্যাদি স্থাপন করা হয়।

প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানা স্থাপনের কাজ চলছে। সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় সিরাজগঞ্জের লাহিড়ীমোহনপুরে একটি গোখাদ্য কারখানা স্থাপন করে ‘লাভ নয় ক্ষতি নয়’ ভিত্তিতে মিল্ক ইউনিয়নের খামারিদের গোখাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশকে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে মহিষের কৃত্রিম প্রজনন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন, গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, চারণভূমি সৃজন ও কারখানা স্থাপন, গুঁড়োদুধ কারখানা স্থাপন, গবাদিপশুর ওষুধ ও ভ্যাকসিন উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মতো কর্মকাণ্ডও বাস্তবায়ন করছে দেশের সবচেয়ে বড় সমবায় প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের দুধের চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে মিল্ক ভিটা। মিল্ক ভিটার দেখানো পথ ধরে খাতটিতে যুক্ত হয়েছে একাধিক করপোরেট গ্রুপ। যাদের হাত ধরে দেশের সব প্রান্তেই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মানবদেহের পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য।

বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) অমর চান বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মিল্ক ভিটার জন্ম। ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি জনমানসে কাজ করে যাচ্ছে। এখনো মিল্ক ভিটা জনগণের, বিশেষ করে শহুরে জনগণের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে অন্যতম ভূমিকা রেখে চলেছে। একই সঙ্গে সমবায়ী দুগ্ধ খামারিদের ভাগ্যের উন্নয়নেও কাজ করে চলেছে। খামারিরা যাতে তাদের উৎপাদিত দুগ্ধের ন্যায্যমূল্য পায়, সেজন্য মিল্কভিটা সদা সচেষ্ট রয়েছে। করোনাকালেও আমাদের উৎপাদিত পণ্য যাতে সবাই কিনতে পারে সেই সুযোগ রেখেছিলাম। আমরা করোনাকালে কৃষকদের সুবিধার জন্য দুধের দাম দুই টাকা করে বাড়িয়েছিলাম, সম্প্রতি আবার দুই টাকা করে বাড়িয়েছি। আমাদের লক্ষ্য একটাই যাতে আমাদের দরিদ্র প্রান্তিক সমবায়ী খামারিরা সঠিক মূল্য পায়। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের মিল্ক ভিটাকে এগিয়ে নিতে পারি। মিল্ক ভিটাকে শক্তিশালী এবং সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, এ লক্ষ্য সামনে নিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিল্ক ভিটার সঠিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।

অর্ধশতাব্দী আগে যে বাস্তবতায় মিল্ক ভিটার যাত্রা হয়েছিল, বর্তমানের পরিস্থিতি তার চেয়ে ভিন্ন। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। বেড়েছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে দুধের বার্ষিক চাহিদা প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে উৎপাদনে গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে। দুগ্ধ শিল্পের এ সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি তৈরিতে মিল্ক ভিটাকেই বড় কৃতিত্বের দাবিদার মানছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমন আরো সংবাদ

Back to top button