ভ্রমণ

রংরাং সামিট

ভবঘুরের খেরো খাতা

রংরাং এর পথে
রংরাং এর পথে

রংরাং, আলীকদম, বান্দরবন: ভোরের আলো ফোটর আগেই আমরা রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম। ম্যানিয়াং পাড়া থেকে খ্যামচং পাড়া পর্যন্ত আমাদের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপওে উঠতে হবে এবং পথে কোন ছরা নেই। খ্যামচং পাড়া পৌছার আগে অন্য কোন পানির উৎসও নেই, তাই খাবার ও রান্নার পানি আমাদেরকে বহন করতে হবে। সেই সঙ্গে খাবার, ব্যাগ, তাবু ও অন্যান্য উপকরণ মিলে বেশ ভাড়িই বলা যায়। প্রথমে আমরা রংরাং সামিট করবো তারপর যাবো খ্যামচং পাড়া, সেখানে দুপুড়ের খাবার খেয়ে নামবো ক্রিস্তং এর পথে। একদম টাইট সিডিউল। তাই রাত চারটার পর আমাদের গাইড লেং মুরংকে নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম মেনিয়াং পাড়া থেকে, সময় বাচাতে আমরা নাস্তা না করেই বের হলাম, প্রথম যাত্রা বিরতিতে নাস্তা সারা হবে। আজকের নাস্তার মেনু শুকনা খেজুর, চিড়ার মোয়া, ডাল ভাজা আর খেজুরের গুড়।
ম্যানিয়াং পাড়া থেকে রংরাং কতদুর জানতে চাইতে না চাইতেই ল্যাং মুরংয়ের উত্তর দেড় থেকে দুই ঘন্টার পথ, যেনো এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলেন লেং মুরং। পাহাড়ি জনপদের ভিতরে ঢুকলে একটি জিনিস দেখবেন স্থানীয় লোকজন দুরত্ব মাপার জন্য কিলোমিটার বা মাইল ব্যবহার না করে ব্যবহার করে সময়। সকালের আড়ষ্ঠ পায়ে শুরু হলো দের – দু ঘন্টা দুরতের ট্রেকিং। অন্ধকারের মধ্যে টর্চ হাতে সামনে থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ল্যাং মুরং। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমরা শুধু উঠছি আর উঠছি, এর যেনো শেষ নেই।

পাহারের উপর থেকে দেখা ম্যানিয়াং পাড়া
পাহারের উপর থেকে দেখা ম্যানিয়াং পাড়া

আমাদের পরিকল্পনা ছিল যাওয়ার পথে কোন এক জুম ঘরে আমাদের ব্যাগ রেখে আমরা রংরাং সামিট করবো, যাতে কষ্ট কম হয় এবং নেমে যাওার সময় ব্যাগ গুলো নিয়ে চলে যাবো সোজা খ্যামচং পাড়া। ম্যানিয়াং পাড়া থেকে যাত্রা শুরু করে পাহাড়ের উপর উঠে পিছন ফিরে তাকাতেই অবিভুত হয়ে গেলাম। ততক্ষনে রাতের অন্ধকার ভেদ করে দিনের আলোচ্ছটা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। পাহাড়ের উপর থেকে ম্যানিয়াং পাড়াকে ছোট্ট সুন্দর একটা কল্পনার গ্রাম বলে মনে হচ্ছিলো। এই সৌন্দর্য্য কল্পনাকেও হার মানায়, যে সৌন্দর্য্য আপনাকে বার বার টেনে নিয়ে আসবে গাহাড়ের কাছে, আড়ষ্ট পদযুগলকে আরও আড়ষ্ঠ করে দেবে, অজানা এক আকর্ষণ সামনে এগুতে দেবে না। আমরা ম্যানিয়াং পাড়ার মায়া ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই, কিনÍু নাস্তা না করে বের হবার কারনে আধা ঘন্টা যেতে না যেতেই পথে একবার যাত্রা বিরতি নিতে হলো। সকালের নাস্তা, সেই খেজুর, চকলেট, চিড়ার মোয়া, গুড় ও পানি। মধ্যে ফটোগ্রফি, পাহাড়ের উপর থেকে দুরের গ্রাম ও পাহাড়গুলি চেনা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে বেশ কিছু সময় ব্যয় হলো। তাছাড়া সকাল বেলার আষ্ঠতার কারণে আমরা একটু ধীরে সুস্থে এগোচ্ছিলাম। বিশেষ করে আমাকে গত কালের মাসল ক্রাম্পের ব্যাথা বেশ ভোগাচ্ছিল, সুযোগ পেলেই ভলিজেল মেখে ম্যাসেজ করে নিচ্ছিলাম।
রাস্তায় কোন জুমঘর না পেয়ে ঝোপের আড়ালে ব্যাগ, তাবু রেখে রংরাং এর শেষ চূড়ায় ওঠা শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম কেন ল্যাং দা ব্যাগ রেখে চূড়ায় উঠার কথা বলেছেন, বেশ কয়েকবার প্রায় ৯০ ডিগ্রি পাহাড় বেয়ে উঠতে হলো, ভারি ব্যাগ নিয়ে যেটা কখনোই সম্ভব হতো না। আমাদের দলের প্রত্যেকেই ট্রেকিংএ অভ্যস্থ ও দক্ষ। হাসান ভাই ও উসাই মার্মা তো বেড়েই উঠেছেন পাহাড়ে। বর্তমানে পেশায় গাইড, সপ্তাহে সাত দিনই দাপিয়ে বেড়ান বান্দরবনের বিভিন্ন চুড়ায়। আর কিরণ ভাই গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে যেনো ঘর বেধেছেন, পেশায় ট্যুর গ্রুপ বিডির গাইড, সেই সুত্রে বেশির ভাগ সময় কাটান পাহাড়ে, আর যে কয় দিন ফাকা পান মেতে থাকেন নুতন কোন চুড়া অথবা নুতন কোন ঝর্ণা জয়ের আনন্দে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে ট্রেকিংয়ে আমিই সব থেকে নবীন।
আর কোন বিশ্রাম না নিয়ে সব বাধা বিপত্তি এড়িয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে আমরা লক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম দ্রুত গতিতে। আমি ক্রাম্পের ব্যাথাকে পাত্তা না দিয়ে, দাতে দাত চেপে দলের সাথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সমান গতিতে। নিজেকে মাশরাফি মনে হচ্ছিলো! অবশেষে প্রায় দুই ঘন্টার ট্রেকিং শেষে সকাল ০৭ টার কাছাকাছি সময়ে আমরা রংরাং সামিট করলাম। (চলবে)

এমন আরো সংবাদ

Back to top button