ভ্রমণ

কাঁধে ৩০ কেজি, উঠতে হবে দুই হাজার ফুট উপরে

ভবঘুরের খেরোখাতা

আলীকদমআট দশ কদম যেতে না যেতেই পায়ের উরুর মাসলে টান পড়লো (ক্রাম্প করল), প্রথমে ডান পায়ে, তারপর বাম পায়ে। সম্ভবত সাড়ে ছয়টা কি সাতটার মতো বাজে, দিনের আলো মিলিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন আগেই। জোছনার আলোয় গাইড পালে মুরংসহ আমরা পাঁচ ভবোঘুরে পাহাড়ের নিস্তব্ধতার চাদর ভেদ করে হাঁটছিলাম ম্যানকিউ পাড়ার পোড়া জুম ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। চারপাশে ধোঁয়া মাঝে মাঝে কিছু গাছে তখনও আগুন জ্বলছিল, চারপাশ থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসছিল লাল আভা, কেমন যেন একটা অপার্থিব পরিবেশ। উপায় না দেখে পথেই শুয়ে পড়লাম, মনে হচ্ছিল আমি আর এক পাও সামনে এগুতে পারবো না।

ম্যানকিউ পাড়া থেকে ম্যানিয়্যাং পাড়া ৪ ঘন্টার পথ। প্রথমেই একটা ঝিরি আছে এর পর আর কোন ঝিরি নেই, তাই যত বেশি সম্ভব পানি বহন করতে হবে আমাদের। দিনের বেলা রোদের মধ্যে এই পথে ট্রেকিং করা মোটামুটি কষ্টসাধ্য, পালে মুরং ও রাজী আছে গাইড হিসেবে আমাদের সঙ্গে ম্যানিয়্যাং পাড়া পর্যন্ত যেতে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তখুনি ম্যানিয়্যাং পাড়ার পথে নামার।

aliপুরো তিন মাস দুই দিন পর পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করেছি, তার উপর তাবু, পাঁচ দিনের খাবার, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সহ ৩০ কেজির চেয়ে বেশি ওজনের ব্যাগ পিঠে। যত সময় যাচ্ছিল আমরা আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। পা যেন অসার হয়ে আসছিল। আমাদের গন্তব্য প্রায় ২ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ম্যানিয়্যাং পাড়া। খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে হচ্ছিল, পরক্ষনেই আবার খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নেমে আবার উপরে ওঠো। কোনক্রমে পা পিছলালে একদম খাদের নীচে। এর মাঝেই সূর্য অস্ত গেল, আকাশে দেখা দিল রুপোলি থালার মত চাঁদ। আমাদের বারবার বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। পথের মাঝে বাশের তৈরী বসার জায়গা পেয়ে সকলে বসে, সাথে থাকা খাবার ও স্যালাইন খেলাম। ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুরিয়ে আসছিল, ওখানেই শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। উঠে পা বাড়াতেই বুঝলাম শরীর ঠান্ডা হওয়ায়, পা উঠতে চাচ্ছেনা, মাসল ক্রাম্প করার সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। ওয়ার্ম আপ করে, ষ্ট্রেচিং করে পা বাড়ালাম ম্যানিয়্যাং পাড়ার পথে।

আট দশ কদম যেতে না যেতেই ভয়ংকর সেই যন্ত্রনাদায়ক ঘটনাটা ঘটলো, পায়ের উরুর মাসলে টান ধরল (ক্রাম্পকরল), প্রথমে ডান পায়ে তার পর বাম পায়ে। কিছুতেই সোজা হয়ে দাড়াতে পারছিলাম না। আমরা হাঁটছিলাম ম্যানকিউপাড়ার পোড়া জুম ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। পাহাড়ে জুম চাষের আগে পুরোনো ক্ষেতে আগুন দিয়ে পুরোনো ফসলের গাছ ও আগাছা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চারপাশে ধোঁয়া, মাঝে মাঝে কিছু গাছ, তখনও জ্বলছিল, উপায় না দেখে পথেই শুয়ে পড়লাম, আর এক পাও সামনে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো না। যাদের মাসল ক্রাম্পের বাজে অভিজ্ঞতা আছে শুধু তারাই বুঝতে পারবেন মাসল ক্রাম্পে কি তীব্র ব্যথা হয়। নিজের অজান্তেই ব্যাথায় চোখের কোনা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল পোড়া জুম ক্ষেতে। চাঁদের আলোয় তা কারও চোখে পড়ল কি না জানিনা। পড়লেও কারও কিছু করার ছিল না। দীর্ঘ ট্রেকিংয়ে সকলে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। একবার ভাবলাম আমি আর পারবো না, পরক্ষনেই মুষ্টিবদ্ধ হাতে পরাজিত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। নিজে নিজেই ম্যাসেজ, তারপর ষ্ট্রেচিং, অতঃপর ভলিজেল মেখে পা বাড়াই আমার জীবনের সবচেয়ে ব্যাথাময়, সবচেয়ে কষ্টকর ট্রেকিংএ। প্রতি পদক্ষেপে কি পরিমান ব্যাথা সহ্য করতে হয়েছে সেটা বর্ণনা করা সম্ভব না। চোখের জলে, গায়ের ঘামে দেহ ভিজিয়ে, পোশাক ভিজিয়ে অতঃপর পথ ভিজিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম সামনের দিকে। সেই চোখের জলের সাথে কত অগণিত জাগতিক ভ্রান্ত কষ্ট যে পথে ফেলে এসেছি, তা আর ফিরে দেখতে চাই না।

লেখক : উন্নয়ন কর্মী ও ভূ-পর্যটক

 

এমন আরো সংবাদ

Back to top button